দারসুল কুরআন:সূরা লুক্বমান দ্বিতীয় রুকু(১২-১৯)

দারসুল কুরআন:সূরা লুক্বমান

দ্বিতীয় রুকু(১২-১৯)

আয়াত সমুহঃ

وَلَقَدْ آتَيْنَا لُقْمَانَ الْحِكْمَةَ أَنْ اشْكُرْ لِلَّهِ وَمَنْ يَشْكُرْ فَإِنَّمَا يَشْكُرُ لِنَفْسِهِ وَمَنْ كَفَرَ فَإِنَّ اللَّهَ غَنِيٌّ حَمِيدٌ [12].

وَإِذْ قَالَ لُقْمَانُ لابْنِهِ وَهُوَ يَعِظُهُ يَا بُنَيَّ لا تُشْرِكْ بِاللَّهِ إِنَّ الشِّرْكَ لَظُلْمٌ عَظِيمٌ [13]

وَوَصَّيْنَا الإِنسَانَ بِوَالِدَيْهِ حَمَلَتْهُ أُمُّهُ وَهْناً عَلَى وَهْنٍ وَفِصَالُهُ فِي عَامَيْنِ أَنْ اشْكُرْ لِي وَلِوَالِدَيْكَ إِلَيَّ الْمَصِيرُ [14]

وَإِنْ جَاهَدَاكَ عَلى أَنْ تُشْرِكَ بِي مَا لَيْسَ لَكَ بِهِ عِلْمٌ فَلا تُطِعْهُمَا وَصَاحِبْهُمَا فِي الدُّنْيَا مَعْرُوفاً وَاتَّبِعْ سَبِيلَ مَنْ أَنَابَ إِلَيَّ ثُمَّ إِلَيَّ مَرْجِعُكُمْ فَأُنَبِّئُكُمْ بِمَا كُنتُمْ تَعْمَلُونَ [15]

يَا بُنَيَّ إِنَّهَا إِنْ تَكُ مِثْقَالَ حَبَّةٍ مِنْ خَرْدَلٍ فَتَكُنْ فِي صَخْرَةٍ أَوْ فِي السَّمَوَاتِ أَوْ فِي الأَرْضِ يَأْتِ بِهَا اللَّهُ إِنَّ اللَّهَ لَطِيفٌ خَبِيرٌ [16]

يَا بُنَيَّ أَقِمْ الصَّلاةَ وَأْمُرْ بِالْمَعْرُوفِ وَانْهَ عَنْ الْمُنكَرِ وَاصْبِرْ عَلَى مَا أَصَابَكَ إِنَّ ذَلِكَ مِنْ عَزْمِ الأُمُورِ [17]

وَلا تُصَعِّرْ خَدَّكَ لِلنَّاسِ وَلا تَمْشِ فِي الأَرْضِ مَرَحاً إِنَّ اللَّهَ لا يُحِبُّ كُلَّ مُخْتَالٍ فَخُورٍ [18]

وَاقْصِدْ فِي مَشْيِكَ وَاغْضُضْ مِنْ صَوْتِكَ إِنَّ أَنكَرَ الأَصْوَاتِ لَصَوْتُ الْحَمِيرِ [19]

Translation:

(12) We bestowed wisdom on Luqmān: ‘Be grateful to God; for he who is grateful is only grateful for his own benefit. As for the one who is ungrateful; well, God is self-sufficient, ever to be praised.

(13) Luqmān said to his son, admonishing him: ‘My dear son! Do not associate any partners with God; for, to associate partners with Him is indeed a great wrong.’

(14) We have enjoined upon man goodness to his parents: his mother bore him going from weakness to weakness, and his weaning takes place within two years. Be grateful to Me and to your parents. With Me is the end of all journeys.

(15) Yet should they endeavour to make you associate as partner with Me something of which you have no knowledge, do not obey them, but [even then] bear them company in this world’s life with kindness, and follow the path of those who turn towards Me. In the end, it is to Me that you shall all return, when I shall inform you about all that you were doing [in life].

(16) ‘My dear son! If there be something which is no more than the weight of a grain of mustard seed, and though it be hidden in a rock, or in the skies, or in the earth, God will bring it forth. God is Gracious, All-Aware.

(17) My dear son! Attend regularly to prayer, and enjoin the doing of what is right and forbid the doing of what is wrong, and endure with fortitude whatever befalls you. These are matters that require strong resolve.

(18) Do not turn your cheek away from people in false pride, nor walk haughtily on earth. God does not love anyone who is arrogant, boastful. (18)

(19) Be of modest bearing in your walk, and lower your voice; for the most hideous of voices is the braying of the ass.’

বাংলা অনুবাদঃ

১২) আমি লুকমানকে দান করেছিলাম প্রজ্ঞা, যাতে সে আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞ হয় ৷ যে ব্যক্তি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবে তার কৃতজ্ঞতা হবে তার নিজেরই জন্য লাভজনক৷ আর যে ব্যক্তি কুফরী করবে, (জেনে রেখ)সে ক্ষেত্রে প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ অমুখাপেক্ষী এবং নিজে নিজেই প্রশংসিত ৷

১৩)
(স্মরণ করো) যখন লুকমান নিজের ছেলেকে উপদেশছলে বললো, “ হে পুত্র ! আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করো না৷ নিশ্চয়ই শিরক খুব মারাত্মক অন্যায়৷

১৪) আর প্রকৃতপক্ষে আমি মানুষকে তার পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহারের জোর তাকিদ করেছি৷ তার মা কষ্টের পর কষ্ট সহ্য করে তাকে আপন গর্ভে ধারণ করে এবং দু’বছর লাগে তার দুধ ছাড়তে৷ (এ জন্য আমি তাকে উপদেশ দিয়েছি) আমার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করো এবং নিজের পিতা-মাতার প্রতিও, (কেননা)আমার দিকেই তোমাকে ফিরে আসতে হবে৷

১৫) কিন্তু যদি তারা তোমার প্রতি আমার সাথে এমন কাউকে শরীক করার জন্য চাপ দেয় যার সম্পর্কে তুমি জানো না, তাহলে তুমি তাদের কথা কখনোই মেনে নিয়ো না৷ তবুও দুনিয়ায় তাদের সাথে সদ্ভাবে সহাবস্থান করতে থাকো। বরং মেনে চলো সে ব্যক্তির পথ যে আমার দিকে ফিরে এসেছে৷ তারপর তোমাদের সবাইকে ফিরে আসতে হবে আমারই দিকে৷ সে সময় তোমরা কেমন কাজ করছিলে তখন তা আমি তোমাদেরকে জানিয়ে দেবো৷

১৬) (আর লুকমান বলেছিল ) “ হে পুত্র! কোন জিনিস যদি সরিষার দানা পরিমাণও হয় এবং তা লুকিয়ে থাকে পাথরের মধ্যে , আকাশে বা যমিনের মধ্যে কোথাও , তাহলে আল্লাহ তাো বের করে নিয়ে আসবেন৷ কারণ তিনি সূক্ষ্মদর্শী এবং সবকিছু জানেন৷

১৭) হে পুত্র! নামায কায়েম করো, সৎকাজের হুকুম দাও, খারাপ কাজে নিষেধ করো এবং যত বিপদই আসুক সে জন্য সবর করো৷ একথাগুলোর জন্য অবশ্যই জোর তাকিদ করা হয়েছে৷

১৮) আর অহঙ্কারবশে মানুষকে অবজ্ঞা করোনা, পৃথিবীর বুকে উদ্ধত ভঙ্গিতে চলো না, আল্লাহ কোন দাম্ভিক ও অহংকারীকে পছন্দ করেন না৷

১৯) নিজের চালচলনে ভারসাম্য আনো এবং কণ্ঠস্বর নীচু করো৷ নিঃসন্দেহে গাধার আওয়াজই সব আওয়াজের মধ্যে সবচেয়ে অপ্রীতিকর৷

সূরা পরিচিতিঃ

-মক্বী সূরা -৩১ নং সূরা -আয়াত সংখ্যা ৩৪ -রুকু সংখ্যা ৪ -পারা ২১

নামকরণঃ

এ সূরার দ্বিতীয় রুকুতে লুকমান হাকীমের উপদেশাবলী উদ্ধৃত করা হয়েছে। একারণে এ সূরার লুকমান নামকরণ করা হয়েছে।

নাযিলের সময়কালঃ

অধিকাংশ মুফাসসিরের মতে, সূরা লুক্বমান অবতীর্ণ হয়েছিল মক্বী যুগে সূরা আনকাবূতের আগে।

এ সূরার বিষয়বস্তু সম্পর্কে চিন্তা করলে পরিষ্কার বুঝা যায়, এটি এমন সময় নাযিল হয় যখন ইসলামের দাওয়াতের কণ্ঠরোধ এবং তার অগ্রগতির পথরোধ করার জন্য জুলুম-নিপীড়নের সূচনা হয়ে গিয়েছিল এবং এ জন্য বিভিন্ন উপায় অবলম্বন করা হচ্ছিল। কিন্তু তখনও বিরোধিতা তোড়জোড় ষোলকলায় পূর্ণ হয়নি। ১৪ ও ১৫ আয়াত থেকে এর আভাস পাওয়া যায়। সেখানে নতুন ইসলাম গ্রহণকারী যুবকদের বলা হয়েছে , পিতা-মাতার অধিকার যথার্থই আল্লাহর পরে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু তারা যদি তোমাদের ইসলাম গ্রহণ করার পথে বাধা দেয় এবং শিরকের দিকে ফিরে যেতে বাধ্য করে তাহলে তাদের কথা কখনোই মেনে নেবে না। একথাটাই সূরা আনকাবুতেও বলা হয়েছে। এ থেকে জানা যায় যে, দুটি সূরাই একই সময় নাযিল হয়। কিন্তু উভয় সূরার বর্ণনা রীতি ও বিষয়বস্তুর কথা চিন্তা করলে অনুমান করা যায় সূরা লোকমান প্রথমে নাযিল হয়। কারণ এর পশ্চাতভূমে কোন তীব্র আকারের বিরোধিতার চিহ্ন পাওয়া যায় না। বিপরীত পক্ষে সূরা আনকাবুত পড়লে মনে হবে তার নাযিলের সময় মুসলমানদের ওপর কঠোর জুলুম নিপীড়ন চলছিল।

বিষয়বস্তু ও মূল বক্তব্যঃ

সূরা লুক্বমানের কেন্দ্রীয় আলোচ্য বিষয় হল আল্লাহ্‌র একত্ববাদ।

সত্যের পথ থেকে দূরে সরে যাওয়া মানুষের মনের সকল প্রশ্নের জবাব নিয়ে এ সূরা অবতীর্ণ হয়েছে। এ সূরায় লোকদের বুঝানো হয়েছে , শিরকের অসারতা ও অযৌক্তিকতা এবং তাওহীদের সত্যতা ও যৌক্তিকতা। এই সঙ্গে আহ্বান জানানো হয়েছে এই বলে যে, বাপ-দাদার অন্ধ অনুসরণ ত্যাগ করো, মুহাম্মদ (সা) সম্পর্কে উন্মুক্ত হৃদয়ে চিন্তা-ভাবনা করো এবং উন্মুক্ত দৃষ্টিতে দেখো, বিশ্ব- জগতের চারদিকে এবং নিজের মানবিক সত্তার মধ্যেই কেমন সব সুস্পষ্ট নিদর্শন এর সত্যতার সাক্ষ দিয়ে চলছে।

এ প্রসঙ্গে একথাও বলা হয়েছে, দুনিয়ায় বা আরবদেশে এই প্রথমবার মানুষের কাছে সম্পূর্ণ অপরিচিত একটি আওয়াজ উঠানো হয়নি। আগেও লোকেরা বুদ্ধি-জ্ঞানের অধিকারী ছিল এবং তারা একথাই বলতো যা আজ মুহাম্মদ (সা) বলছেন। তোমাদের নিজেদের দেশেই ছিলেন মহাজ্ঞানী লুকমান। তার জ্ঞানগরিমার কাহিনী তোমাদের এলাকায় বহুল প্রচলিত। তোমরা নিজেদের কথাবার্তায় তার প্রবাদ বাক্য ও জ্ঞানগর্ভ কথা উদ্বৃত্ত করে থাকো। তোমাদের কবি ও বাগ্মীগণ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তার কথা বলেন। এখন তোমরা নিজেরাই দেখো তিনি কোন ধরনের আকীদা- বিশ্বাস ও কোন ধরনের নীতি-নৈতিকতার শিক্ষা দিতেন।

ব্যাখ্যাঃ

১২ নং আয়াতের ব্যাখ্যা-

وَلَقَدْ آتَيْنَا لُقْمَانَ الْحِكْمَةَ.

অর্থাৎ আমি লুকমানকে দান করেছিলাম প্রজ্ঞা।

লুক্বমান হাকীমের পরিচয়-

জাহেলিয়াতের অন্ধকার যুগে কোন লিখিত ইতিহাসের অস্তিত্ব ছিল না। ঐতিহাসিক দৃষ্টিতে তাই লুকমানের পরিচয়ের ব্যাপারে ব্যাপক মতবিরোধ দেখা যায়-

# শত শত বছর থেকে মুখে মুখে শ্রুত যেসব তথ্য স্মৃতির ভাণ্ডারে লোককাহিনী-গল্প-গাঁথার আকারে সংগৃহিত হয়ে আসছিল সেগুলোর ওপর ছিল এর ভিত্তি। এসব বর্ণনার প্রেক্ষিতে কেউ কেউ হযরত লকুমানকে আদ জাতির অন্তর্ভুক্ত ইয়ামনের বাদশাহ মনে করতো। মাওলানা সাইয়েদ সুলাইমান নদবী এসব বর্ণনার ওপর নির্ভর করে তার “আরদুল কুরআন” গ্রন্থে এ মত প্রকাশ করেছেন যে, আদ জাতির ওপর আল্লাহর আযাব নাযিল হবার পর হযরত হূদের (আ) সাথে তাদের যে ঈমানদার অংশটি বেঁচে গিয়েছিল লুকমান ছিলেন তাদেরই বংশোদ্ভূত। ইয়ামনে এ জাতির যে শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তিনি ছিলেন তার অন্যতম শাসক ও বাদশাহ।

# কিন্তু কতিপয় প্রবীণ সাহাবী ও তাবেঈদের মাধ্যমে প্রাপ্ত অন্য বর্ণনাগুলো এর সম্পূর্ণ বিপরীত।

-ইবনে আব্বাস (রা) বলেন, লুকমান ছিলেন একজন আবিসিনীয় গোলাম, যিনি কাঠ কাটার কাজ করতেন। হযরত আবু হুরাইরা (রা), মুজাহিদ, ইকরিমাহ ও খালেদুর রাব’ঈও একথাই বলেন। তাছাড়া ইবনে আবী শাইবাহ, আহমাদ, ইবনে জারীর, ইবনুল মুনযির প্রমুখ যুহদ নামক গ্রন্থে এরূপ বর্ণনা করেছেন।

-হযরত জাবের ইবনে আবদুল্লাহ আনসারী (রা) বলেন, তিনি ছিলেন নূবার অধিবাসী।

-সাঈদ ইবনে মুসাইয়েবের উক্তি হচ্ছে, তিনি মিসরের কালো লোকদের অন্তরভুক্ত ছিলেন।

এ তিনটি বক্তব্য প্রায় কাছাকাছি অবস্থান করছে। কারণ আরবের লোকেরা কালো বর্ণের মানুষদেরকে সেকালে প্রায়ই হাবশী বলতো। আর নূবা হচ্ছে মিসরের দক্ষিণে এবং সুদানের উত্তরে অবস্থিত একটি এলাকা। তাই তিনটি উক্তিতে একই ব্যক্তিকে নূবী, মিসরীয় ও হাবশী বলা কেবলমাত্র শাব্দিক বিরোধ ছাড়া আর কিছুই নয়। অর্থের দিক দিয়ে এখানে কোন বিরোধ নেই।

তা ছাড়া সুহাইলী আরো বিস্তারিত ভাবে বলেছেন যে, লুকমান হাকীম ও লুকমান ইবনে আদ দু’জন আলাদা ব্যক্তি। তাদেরকে এক ব্যক্তি মনে করা ঠিক নয়। (রওদুল আনাফ, ১ম খণ্ড, ২৬৬ পৃষ্ঠা এবং মাসউদী , ১ম খণ্ড, ৫৭ পৃষ্ঠা । )

# তিনি ছিলেন লুক্বমান ইবনে আনকা ইবনে সুদূন। সুহাইলির(র.) মতে তাঁর পিতার নাম ছিল সা’রান।

*যেভাবে তাঁর কথা প্রসিদ্ধি লাভ করে-

তারপর রওদাতুল আনাফে সুহাইলির ও মরূজুয যাহাবে মাস’উদীর বর্ণনা থেকে এ সূদানী গোলামের কথা আরবে কেমন করে ছড়িয়ে পড়লো এ প্রশ্নের ওপরও আলোকপাত হয়। এ উভয় বর্ণনায় বলা হয়েছে, এ ব্যক্তি আসলে ছিলেন নূবী। কিন্তু তিনি বাসিন্দা ছিলেন মাদযান ও আইল (বর্তমান আকাবাহ) এলাকার। এ কারণে তার ভাষা ছিল আরবী এবং তার জ্ঞানের কথা আরবে ছড়িয়ে পড়ে।

*তাঁর শারীরিক গঠনঃ

হযরত জাবের ইবনে আব্দুল্লাহর(র) কাছে তাঁর সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, লুক্বমান ছিলেন চ্যাপ্টা ও থ্যাবড়া নাক বিশিষ্ট বেঁটে আকৃতির লোক।

মুজাহিদ(র) এর মতে, তিনি ছিলেন ফাটা পা এবং পুরু ঠোঁট ওয়ালা।(ইবনে কাসীর)

*লুক্বমান হাকীম কি নবী ছিলেন?

ইবনে কাসীর(র) এবং ইমাম বাগাবী(র) বলেন, লুক্বমান যে নবী ছিলেননা, বরং ছিলেন বিশিষ্ট ফকীহ ও প্রজ্ঞাবান ব্যক্তি, এ ব্যাপারে মনিষীগণ একমত। কেবল মাত্র ইকরামা(র) এর মতে, তিনি নবী ছিলেন। তবে তার বর্ণনাসূত্র অত্যন্ত দুর্বল।

কাতাদাহ(রা) থেকে একটি রেওয়ায়াতে উল্লেখ আছে, আল্লাহ্‌ পাক লুকমানকে নবুয়্যত এবং প্রজ্ঞার মধ্যে যে কোন একটি বেছে নেয়ার সুযোগ দিলে তিনি প্রজ্ঞাকেই বেছে নেন। কোন কোন বর্ণনায় আছে, নবুয়্যত গ্রহনের সুযোগ দেয়া হলে তিনি বলেন- এটা আপনার আদেশ হলে অবশ্যই শিরোধার্য। অন্যথায় আমাকে ক্ষমা করুন। হযরত কাতাদাহ(রাঃ) এর থেকে আরও বর্ণিত আছে যে, মনিষী লুকমানের কাছে এক ব্যক্তি নবুয়ত গ্রহন না করে প্রজ্ঞা গ্রহন করার কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, নবুয়্যত একটি বিশেষ দায়িত্বপূর্ণ পদ। যদি আল্লাহ্‌ তা আমার ইচ্ছা ব্যতিতই দিতেন, তাহলে এর দায়িত্ব তিনি নিজেই নিতেন যেন আমি ভালোভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারি। আমি চেয়ে নিলে সে দায়িত্ব আমার উপর বর্তাত।(ইবনে কাসীর)

মোদ্দা কথা হল, একজন বুদ্ধিমান ও জ্ঞানী হিসেবে আরবে লুকমান বহুল পরিচিত ব্যক্তিত্ব। জাহিলী যুগের কবিরা যেমন ইমরাউল কায়েস, লবীদ, আ’শা , তারাফাহ প্রমুখ তাদের কবিতায় তার কথা বলা হয়েছে। আরবের কোন কোন লেখাপড়া জানা লোকের কাছে “সহীফা লুকমান ” নামে তার জ্ঞানগর্ভ উক্তির একটি সংকলন পাওয়া যেতো।

হাদীসে উদ্ধৃত হয়েছে, হিজরাতের তিন বছর পূর্বে মদীনার সর্বপ্রথম যে ব্যক্তি নবী (সা) এর দাওয়াতের প্রভাবিত হন তিনি ছিলেন সুওয়াইদ ইবনে সামেত। তিনি হজ্ব সম্পাদন করার জন্য মক্কায় যান। সেখানে নবী করীম (সা) নিজের নিয়ম মতো বিভিন্ন এলাকা থেকে আগত হাজীদের আবাসস্থলে গিয়ে ব্যক্তিগতভাবে প্রত্যেককে ইসলামের দাওয়াত দিতে থাকেন। এ প্রসঙ্গে সুওয়াইদ যখন নবী (সা) এর বক্তৃতা শুনেন, তাকে বলেন, আপনি যে ধরনের কথা বলেছেন তেমনি ধরনের একটি জিনিস আমার কাছেও আছে। তিনি জিজ্ঞেস করেন, সেটা কি ৷ জবাব দেন সেটা লুকমানের পুস্তিকা । তারপর নবী করীমের (সা) অনুরোধে তিনি তার কিছু অংশ পাঠ করে তাকে শুনান। তিনি বলেন, এটা বড়ই চমৎকার কথা। তবে আমার কাছে এর চেয়েও বেশি চমৎকার কথা আছে। এরপর কুরআন শুনান। কুরআন শুনে সুওয়াইদ অবশ্যই স্বীকার করেন, নিসন্দেহে এটা লুকমানের পুস্তিকার চেয়ে ভালো।(সিরাতে ইবনে হিশাম, ২ খণ্ড, ৬৭-৬৯ পৃ; উসুদুল গাবাহ, ২ খণ্ড, ৩৭৮ পৃষ্ঠা)

الْحِكْمَة*َ শব্দটি কোরআন কারীমের বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে, যেমন- বিদ্যা, বিবেক, গাম্ভীর্য, নবুয়ত, মতের বিশুদ্ধতা ইত্যাদি। আবু হাইয়ান বলেছেন- এটা দ্বারা এমন কিছু বাক্য সমষ্টিকে বুঝানো হয়, যা দ্বারা মানুষ উপদেশ গ্রহন করতে পারে, যা অন্তরকে প্রভাবান্বিত করে এবং যা মানুষ সংরক্ষণ করে অপরের কাছে পৌঁছায়। হযরত ইবনে আব্বাস(রাঃ) এর মতে, হিকমাহ অর্থ- বিবেক, প্রজ্ঞা, মেধা।
তবে অধিকাংশ মুফাসসির হিকমাহ শব্দের শাব্দিক অর্থ করেন প্রজ্ঞা এবং পারিভাষিক অর্থ- ‘কাজে পরিণত করার জ্ঞান’ বলে থাকেন। আর এটাই সবচেয়ে প্রসিদ্ধ মত।

أَنْ اشْكُرْ لِلَّهِ

অর্থাৎ যাতে সে আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞ হয় ৷

এই বাক্যাংশের আগে ‘আমরা বললাম’ উহ্য রয়েছে বলে ধরে নেয়া হয়। তখন এর অর্থ হয়- আমি লুক্বমানকে প্রজ্ঞা প্রদান পূর্বক বললাম যে, আমার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর। অনেক তাফসীর কারকগন বলে থাকেন যে, أَنْ اشْكُرْ স্বয়ং হিকমতেরই ব্যাখ্যা। অর্থাৎ লুক্বমানকে যে হিকমত দেয়া হয়েছিল, তা হল তার প্রতি আমার কৃতজ্ঞতা প্রদানের নির্দেশ, যা সে কাজে পরিণত করেছিল। তখন এর অর্থ দাঁড়ায়, মহান আল্লাহ্‌র দয়া এবং অনুগ্রহের জন্য তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশই সবচেয়ে বড় হিকমাহ বা প্রজ্ঞা।

*এখানে একটি প্রশ্ন এসে যায় যে, লুক্বমান হাকীম তো নবী ছিলেননা; তাহলে আল্লাহ্‌ কিভাবে তাকে শুকরিয়া আদায়ের আদেশ দিলেন? এর উত্তর হল- তাঁর প্রতি কোরআনে বর্ণিত যে নির্দেশ أَنْ اشْكُرْ لِلَّهِ তা ইলহামের মাধ্যমেও হতে পারে, যা আল্লাহ্‌র ওলীগণ লাভ করে থাকেন। তবে আল্লাহ্‌ই এ সম্পর্কে ভালো জানেন।

وَمَنْ يَشْكُرْفَإِنَّمَا يَشْكُرُ لِنَفْسِهِ

অর্থাৎ যে ব্যক্তি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবে তার কৃতজ্ঞতা হবে তার নিজেরই জন্য লাভজনক৷

যেমন কোরানেরই অন্যত্র বলা হয়েছে, যারা সৎকর্ম করে, তারা নিজেদেরই জন্য রচনা করে সুখশয্যা।(৩০:৪৪) আরেক জায়গায় আল্লাহ্‌ বলেছেন, যদি তোমরা কৃতজ্ঞ হও, তবে আমি (নেয়ামত) অবশ্যই বাড়িয়ে দিব।

ধর্মীয় সম্পদের বৃদ্ধি ইহকাল-পরকাল, উভয় স্থানেই হয়। দুনিয়ায় নিয়ামতের শুকরিয়া আদায় করলে জ্ঞান এবং আমলের দক্ষতা বেড়ে যায়। আর পরকালের জন্য বিপুল সাওয়াবের অধিকারী হওয়া যায়।

وَمَنْ كَفَرَ فَإِنَّ اللَّهَ غَنِيٌّ حَمِيدٌ

আর যে ব্যক্তি কুফরী করবে, (জেনে রেখ)সে ক্ষেত্রে প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ অমুখাপেক্ষী এবং নিজে নিজেই প্রশংসিত ৷

অর্থাৎ যে ব্যক্তি কুফরী করে তার কুফরী তার নিজের জন্য ক্ষতিকর। এতে আল্লাহর কোন ক্ষতি হয় না। তিনি অমুখাপেক্ষী । কারো কৃতজ্ঞতার মুখাপেক্ষী নন। কারো কৃতজ্ঞতা তার সার্বভৌম কর্তৃত্বে কোন বৃদ্ধি ঘটায় না। বান্দার যাবতীয় নিয়ামত যে একমাত্র তার দান করো অকৃতজ্ঞতা ও কুফরী এ জাজ্জ্বল্যমান সত্যে কোন পরিবর্তন ঘটাতে পারে না। কেউ তার প্রশংসা করুক বা নাই করুক তিনি আপনা আপনিই প্রশংসিত। বিশ্ব-জাহানের প্রতিটি অণু-কণিকা তার পূর্ণতা ও সৌন্দর্য এবং তার স্রষ্টা ও অন্নদাতা হবার সাক্ষ দিচ্ছে এবং প্রত্যেকটি সৃষ্ট বস্তু নিজের সমগ্র সত্তা দিয়ে তার প্রশংসা গেয়ে চলছে।

১৩ নং আয়াতের ব্যাখ্যা-

লুক্বমান হাকীম তাঁর পুত্রকে ৪ ধরণের উপদেশ দিয়েছিলেন, যা ১৩-১৯ নং আয়াতে এসেছে। এসব জ্ঞানগর্ভ কথাগুলোর মধ্যে সর্বাগ্রে এসেছে আক্বিদার পরিশুদ্ধতা। যার মধ্যে প্রথম উপদেশ তাওহীদ সম্পর্কে। আল্লাহ্‌কে এক ও অদ্বিতীয় হিসেবে মেনে নিয়ে তাঁর ক্ষমতার সাথে কাউকে সমকক্ষ মনে করা যাবেনা। যেমন তিনি বলেছেন-

وَإِذْ قَالَ لُقْمَانُ لابْنِهِ وَهُوَ يَعِظُهُ يَا بُنَيَّ لا تُشْرِكْ بِاللَّهِ

অর্থাৎ (স্মরণ করো) যখন লুকমান নিজের ছেলেকে উপদেশছলে বললো, “ হে পুত্র ! আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করো না৷

লুকমানের পাণ্ডিত্যপূর্ণ উপদেশমালা থেকে এ বিশেষ উপদেশ বাণীটিকে এখানে উদ্ধৃত করা হয়েছে দুটি বিশেষ সম্পর্কের ভিত্তিতে। এক, তিনি নিজ পুত্রকে এ উপদেশটি দেন। আর একথা সুস্পষ্ট, মানুষ যদি দুনিয়ায় সবচেয়ে বেশি কারো ব্যাপারে আন্তরিক হতে পারে তাহলে সে হচ্ছে তার নিজের সন্তান। এক ব্যক্তি অন্যকে ধোঁকা দিতে পারে, তার সাথে মুনাফিকী আচরণ করতে পারে কিন্তু সবচেয়ে নিকৃষ্ট প্রকৃতির লোকটিও নিজ পুত্রকে এ নসীহত করা অকাট্যভাবে প্রমাণ করে যে, তার মতে শিরক যথার্থই একটি নিকৃষ্ট কাজ এবং এ জন্যই তিনি সর্বপ্রথম নিজের প্রাণাধিক পুত্র কে এ গোমরাহীটি থেকে দূরে থাকার উপদেশ দেন। দুই, মক্কার কাফেরদের অনেক পিতা-মাতা সে সময় নিজের সন্তানদেরকে শিরকী ধর্মের ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকার এবং মুহাম্মদ (সা) এর তাওহীদের দাওয়াত থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবার জন্য বাধ্য করছিল। সামনের দিকের একথা বর্ণনা করা হয়েছে। তাই সেই অজ্ঞদেরকে শুনানো হচ্ছে, তোমাদের দেশেরই বহুল পরিচিতি জ্ঞানী পণ্ডিত তো তার নিজের পুত্রের মঙ্গল করার দায়িত্বটা তাকে শিরক থেকে দূরে থাকার নসিহত করার মাধ্যমেই পালন করেন। এখন তোমরা যে তোমাদের সন্তানদেরকে শিরক করতে বাধ্য করছো, এটা কি তাদের প্রতি শুভেচ্ছা না তাদের অমঙ্গল কামনা ৷

إِنَّ الشِّرْكَ لَظُلْمٌ عَظِيمٌ

অর্থাৎ নিশ্চয়ই শিরক খুব মারাত্মক অন্যায়৷

জুলুমের প্রকৃত অর্থ হচ্ছে , কারো অধিকার হরণ করা এবং ইনসাফ বিরোধী কাজ করা। শিরক এ জন্য বৃহত্তর জুলুম যে, মানুষ এমন সব সত্তাকে তার নিজের স্রষ্টা, রিযিকদাতা ও নিয়ামতদানকারী হিসেবে বরণ করে নেয়, তার সৃষ্টিতে যাদের কোন অংশ নেই তাকে রিযিক দান করার ক্ষেত্রে যাদের কোন দখল নেই এবং মানুষ এ দুনিয়ায় যেসব নিয়ামত লাভে ধন্য হচ্ছে সেগুলো প্রদান করার ব্যাপারে যাদের কোন ভূমিকাই নেই। এটা এত অন্যায়, যার চেয়ে বড় কোন অন্যায়ের কথা চিন্তাই করা যায় না। তারপর মানুষ একমাত্র তার স্রষ্টারই বন্দেগী ও পূজা-অর্জনা করে তার অধিকার হরণ করে। তারপর স্রষ্টা ছাড়া অন্য সত্তার বন্দেগী ও পূজা করতে গিয়ে মানুষ যে কাজই করে তাতে সে নিজের দেহ ও মন থেকে শুরু করে পৃথিবী ও আকাশের বহু জিনিস ব্যবহার করে। অথচ এ সমস্ত জিনিস এক লা-শরীক আল্লাহই সৃষ্টি করেছেন এবং এর মধ্যে কোন জিনিসকে আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো বন্দেগীতে ব্যবহার করার অধিকার তার নেই। তারপর মানুষ নিজেকে লাঞ্ছনা ও দুর্ভোগের মধ্যে ঠেলে দেবে না, তার নিজের ওপর এ অধিকার রয়েছে। কিন্তু সে স্রষ্টাকে বাদ দিয়ে সৃষ্টির বন্দেগী করে নিজেকে লাঞ্ছিত ও অপমানিতও করে এবং এই সঙ্গে শাস্তির যোগ্যও বানায়। এভাবে একজন মুশরিকের সমগ্র জীবন একটি সর্বমুখী ও সার্বক্ষণিক জুলুমে পরিণত হয়। তার কোন একটি মুহূর্তও জুলুমমুক্ত নয়।

হযরত আব্দুল্লাহ(রাঃ) থেকে বর্ণিত, যখন এই আয়াতখানা নাযিল হল- “যারা ঈমান এনেছে এবং তাদের ঈমানের সাথে যুলুম মিশ্রিত করেনি” (৬:৮৬); সাহাবাদের কাছে এই কথা খুব কঠিন মনে হয়। তারা জিজ্ঞেস করলেন, আমাদের মধ্যে কে এমন আছে, যে যুলুম করেনা? তখন আল্লাহ্‌র রাসুল(সাঃ) বললেন- তোমরা যা মনে করছ, তা নয়। তোমরা কি হযরত লুক্বমানের কথা শোননি? অতঃপর তিনি উপরের আয়াতটি তেলাওয়াত করেন।(ইবনে কাসীর)

এছাড়া কোরআনের অন্যত্র এসেছে, নিশ্চয়ই আল্লাহ্‌ তায়ালা সকল প্রকার অন্যায় ক্ষমা করে দেবেন, তবে শিরক ছাড়া।(৪;১১৬)

১৪ নং আয়াতের ব্যাখ্যা-

وَوَصَّيْنَا الإِنسَانَ بِوَالِدَيْهِ

অর্থাৎ আর প্রকৃতপক্ষে আমি মানুষকে তার পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহারের জোর তাকিদ করেছি৷

এটি লুক্বমানের পক্ষ থেকে স্বীয় পুত্রের প্রতি প্রথম উপদেশের দ্বিতীয় অংশ- পিতা মাতার প্রতি ইহসান এবং সদ্ব্যবহার করা। আল্লাহ নিজের পক্ষ থেকে লুকমানের উক্তির অতিরিক্ত ব্যাখ্যা হিসেবে একথা বলেছেন।

আল্লাহ্‌ তায়ালা অন্যত্র বলেছেন- তোমার প্রতিপালক আদেশ দিয়েছেন তিনি ছাড়া অন্য কারো ইবাদাত না করতে এবং পিতা মাতার সাথে সদ্ব্যবহার করতে। (১৭:২৩)

এখানেও আরও অনেক জায়গার মত আল্লাহ্‌র ইবাদাতের সাথে সাথে পিতামাতার সাথে সদ্ব্যবহারের ব্যাপারটি এসেছে। এটি দ্বারা এর গুরুত্ব বুঝা যায়।

حَمَلَتْهُ أُمُّهُ وَهْناً عَلَى وَهْنٍ

অর্থাৎ তার মা কষ্টের পর কষ্ট সহ্য করে তাকে আপন গর্ভে ধারণ করে।

وَهْنٍ শব্দের অর্থ কষ্ট, শ্রম, দুর্বলতা; حَمَل বা গর্ভ ধারণ অবস্থায় যা মা সহ্য করেন।

وَفِصَالُهُ فِي عَامَيْن

অর্থাৎ এবং দু’বছর লাগে তার দুধ ছাড়তে৷

এ শব্দগুলো থেকে ইমাম শাফে’ঈ (র), ইমাম আহমাদ (র), ইমাম আবু ইউসুফ (র) ও ইমাম মুহাম্মাদ (র) এ অর্থ গ্রহণ করেছেন যে, শিশুর দুধ পান করার মেয়াদ ২ বছরে পূর্ণ হয়ে যায়। এ মেয়াদকালে কোন শিশু যদি কোন স্ত্রীলোকের দুধপান করে তাহলে দুধ পান করার “হুরমাত” (অর্থাৎ দুধপান করার কারণে স্ত্রীলোকটি তার মায়ের মর্যাদায় উন্নীত হয়ে যাওয়া এবং তার জন্য তার সাথে বিবাহ হারাম হয়ে যাওয়া ) প্রমাণিত হয়ে যাবে। অন্যথায় পরবর্তীকালে কোন প্রকার দুধ পান করার ফলে কোন “হুরমাত” প্রতিষ্ঠিত হবে না। এ উক্তির স্বপক্ষে ইমাম মালেকেরও একটি বর্ণনা রয়েছে। কিন্তু ইমাম আবু হানীফা (র) অতিরিক্ত সতর্কতা অবলম্বন করার উদ্দেশ্যে এ মেয়াদকে বাড়িয়ে আড়াই বছর করার অভিমত ব্যক্ত করেন। এই সঙ্গে ইমাম সাহেব একথাও বলেন, যদি দু’বছর বা এর চেয়ে কম সময়ে শিশুর দুধ ছাড়িয়ে দেয়া হয় এবং খাদ্যের ব্যাপারে শিশু কেবল দুধের ওপর নির্ভরশীল না থাকে, তাহলে এরপর কোন স্ত্রীলোকের দুধ পান করার ফলে কোন দুধপান জনিত হুরমাত প্রমাণিত হবে না। তবে যদি শিশুর আসল খাদ্য দুধই হয়ে থাকে তাহলে অন্যান্য খাদ্য কম বেশি কিছু খেয়ে নিলেও এ সময়ের মধ্যে দুধ পানের কারণে হুরমাত প্রমাণিত হয়ে যাবে। কারণ শিশুকে অপরিহার্যভাবে দু’বছরেই দুধপান করাতে হবে, আয়াতের উদ্দেশ্য এটা নয়। সূরা বাকারায় বলা হয়েছে,

” মায়েরা শিশুদেরকে পুরো দু’বছর দুধ পান করাবে, তার জন্য যে দুধপান করার মেয়াদ পূর্ণ করতে চায় ।” (২৩৩ আয়াত )

ইবনে আব্বাস (রা) থেকে এ সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন এবং উলামায়ে কেরাম এ ব্যাপারে তার সাথে একমত হয়েছেন যে, গর্ভধারণের সর্বনিম্ন মেয়াদ ছ’মাস। কারণ কুরআনের অন্য এক জায়গায় বলা হয়েছে, “তার পেটের মধ্যে অবস্থান করা ও দুধ ছেড়ে দেয়ার কাজ হয় ৩০ মাসে। (আল আহকাফ, আয়াত ১৫) এটি একটি সূক্ষ্ণ আইনগত বিধান এবং এর ফলে বৈধ ও অবৈধ গর্ভের অনেক বিতর্কের অবসান ঘটে।

أَنْ اشْكُرْ لِي وَلِوَالِدَيْكَ إِلَيَّ الْمَصِيرُ

অর্থাৎ (এ জন্য আমি তাকে উপদেশ দিয়েছি) আমার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করো এবং নিজের পিতা-মাতার প্রতিও, (কেননা)আমার দিকেই তোমাকে ফিরে আসতে হবে৷

মায়ের এই কষ্টের কথা এজন্যই মনে করিয়ে দেয়া হচ্ছে যে, সন্তান মায়ের এই মেহেরবানীর কথা মনে করে মায়ের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ, আনুগত্য ও ইহসান করে। যেমন, অন্যত্র আল্লাহ্‌ বলছেন- “বলো, প্রভু! তাদের দুজনের(পিতামাতার) প্রতি দয়া করুন, যেভাবে শৈশবে তাঁরা আমাকে লালন পালন করেছিলেন”।(১৭:২৪)

এখানে মহিমান্বিত আল্লাহ্‌ বলেছেন, তোমাদের প্রত্যাবর্তন তো আমারই কাছে। সুতরাং তোমরা যদি এ আদেশ মেনে নাও, তবে আমিই তোমাদেরকে এর সর্বোচ্চ প্রতিদান দিব।

১৫ নং আয়াতের ব্যাখ্যা-

وَإِنْ جَاهَدَاكَ عَلى أَنْ تُشْرِكَ بِي مَا لَيْسَ لَكَ بِهِ عِلْمٌ فَلا تُطِعْهُمَا

অর্থাৎ কিন্তু যদি তারা তোমার প্রতি আমার সাথে এমন কাউকে শরীক করার জন্য চাপ দেয় যার সম্পর্কে তুমি জানো না, তাহলে তুমি তাদের কথা কখনোই মেনে নিয়ো না৷

এখানে পিতা মাতার আনুগত্যের সীমা রেখা বলে দেয়া হয়েছে। জীবিত থাকা অবস্থায় তাঁদের সাথে সর্বোচ্চ আনুগত্য ও ভালো আচরণ করতে হবে।

যেমন একটি হাদিসে এসেছে- “জিবরীল(আঃ) বললেন, যে নিজের পিতা মাতাকে জীবিত অবস্থায় পেল; অথচ (তাঁদের সন্তুষ্টির মাধ্যমে) জান্নাত নিশ্চিত করতে পারলনা, যে ধ্বংস হোক। রাসুলুল্লাহ(সাঃ) বললেন- আমীন।(বুখারি ও মুসলিম)”

কিন্তু এই আনুগত্যের সীমা রেখা হল- শরীয়ত। অর্থাৎ পিতামাতার আনুগত্য করা ফরয। কিন্তু ইসলাম বিরোধী কোন কাজের ব্যাপারে তারা বাধ্য করতে চাইলে, সেই পিতা মাতার কথা মানাই আবার হারাম হয়ে যাবে।

হযরত সা’দ ইবনে মালিক(রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন- এই আয়াতটি আমারই সম্পর্কে অবতীর্ণ হয়েছে। আমি আমার মায়ের খুবই খেদমত করতাম এবং পূর্ণ অনুগত থাকতাম। আল্লাহ্‌ তায়ালা যখন আমাকে ইসলামের পথে হেদায়াত দান করলেন, আমার মা আমার উপর অসন্তুষ্ট হল। সে আমাকে বলল- “তুমি এই নতুন দ্বীন পেলে কোথায়? জেনে রেখ, আমি তোমাকে নির্দেশ দিচ্ছি যে তোমাকে অবশ্যই এই নতুন দ্বীন পরিত্যাগ করতে হবে। নাহলে আমি পানাহার বন্ধ করে দেব এবং এভাবেই না খেয়ে মারা যাব”। আমি ইসলাম পরিত্যাগ করলাম না। আমার মা’ও খাওয়া দাওয়া বন্ধ করে দিল। ফলে চতুর্দিকে আমার নামে বদনাম ছড়িয়ে পড়ল যে, আমিই আমার মায়ের হন্তাকারক। আমার মন খুব ছোট হয়ে গেল। মায়ের খেদমতে হাযির হয়ে আমি অনুনয় বিনয় করে তাকে বুঝিয়ে বললাম- “তুমি তোমার হঠকারিতা বন্ধ কর। জেনে রেখ, এই সত্য দ্বীন ছেড়ে দেয়া আমার পক্ষে আমার পক্ষে অসম্ভব”। আমার মা এভাবে তিন দিন অতিক্রম করল এবং তার অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয় হয়ে পড়ল। আমি আবারো তার কাছে গিয়ে বললাম- “আম্মা, তুমি আমার কাছে প্রাণপ্রিয় বটে, তাই বলে আমার দ্বীনের চেয়ে বেশি প্রিয় নও। আল্লাহ্‌র কসম, তোমার একটি জীবন কেন, এরকম শত শত জীবনও যদি ক্ষুধা, পিপাসায় কাতর হয়ে একে একে দেহ থেকে বের হয়ে যায় তবুও শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত আমি দ্বীন ইসলামকে পরিত্যাগ করবনা”। এই কথায় আমার মা নিরাশ হয়ে আবার পানাহার শুরু করল। (হাদিসটি ইমাম তিবরানী তাঁর আশারাহ গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন)

সৃষ্ট জীবের মধ্যে মানুষের মধ্যে মানুষের ওপর মা-বাপের হক হচ্ছে সবচেয়ে বেশি। কিন্তু সেই মা- বাপই যদি মানুষকে শিরক করতে বাধ্য করে তাহলে তাদের কথা মেনে নেয়া উচিত নয়। কাজেই এ ক্ষেত্রে অন্য কারো কথায় মানুষের এ ধরনের শিরক করার কোন প্রশ্নই ওঠে না। তারপর শব্দগুলি হচ্ছেঃ ‘ওয়া ইন জাহাদাকা’ অর্থাৎ যদি তারা দু’জন তোমাকে বাধ্য করার জন্য তাদের পূর্ণশক্তি নিয়োগ করে । এ থেকে জানা গেল , কম পর্যায়ের চাপ প্রয়োগ বা বাপ-মায়ের মধ্য থেকে কোন একজনের চাপ প্রয়োগ আরো সহজে প্রত্যাখান করার যোগ্য। এই সঙ্গে ——-“যাকে তুমি আমার শরীক হিসেবে জানো না” বাক্যাংশটিও অনুধাবনযোগ্য। এর মধ্যে তাদের কথা না মানার সপক্ষে একটি শক্তিশালী যুক্তি প্রদান করা হয়েছে। অবশ্যই এটা পিতা-মাতার অধিকার যে, ছেলেমেয়েরা তাদের সেবা করবে, তাদেরকে সম্মান ও শ্রদ্ধা করবে এবং বৈধ বিষয়ে তাদের কথা মেনে চলবে। কিন্তু তাদেরকে এ অধিকার দেয়া হয়নি যে, মানুষ নিজের জ্ঞানের বিরুদ্ধে তাদের অন্ধ অনুসরণ করবে। শুধমাত্র বাপ-মায়ের ধর্ম বলেই তাদের ছেলে বা মেয়ের সেই ধর্ম মেনে চলার কোন কারণ নেই। সন্তান যদি এ জ্ঞান লাভ করে যে, তার বাপ-মায়ের ধর্ম ভুল ও মিথ্যা তাহলে তাদের ধর্ম পরিত্যাগ করে তার সঠিক ধর্ম গ্রহণ করা উচিত এবং তাদের চাপ প্রয়োগের পরও যে পথের ভ্রান্তি তার কাছে সুস্পষ্ট হয়ে গেছে সে পথ অবলম্বন করা তার উচিত নয়। বাপ-মায়ের সাথে যখন এ ধরনের ব্যবহার করতে হবে তখন দুনিয়ার প্রত্যেক ব্যক্তির সাথেও এ ব্যবহার করা উচিত। যতক্ষণ না কোন ব্যক্তির সত্য পথে থাকা সম্পর্কে জানা যাবে ততক্ষণ তার অনুসরণ করা বৈধ নয়।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বাণীও বিষয়টিকে আরও স্পষ্ট ও শক্তিশালী করেন, তিনি বলেন,

« لا طاعة لأحد في معصية الله ، إنما الطاعة في المعروف »

“আল্লাহর নাফরমানিতে কোন মাখলুকের আনুগত্য চলবে না। আনুগত্য-তো হবে একমাত্র ভালো কাজে।”

وَصَاحِبْهُمَا فِي الدُّنْيَا مَعْرُوفاً وَاتَّبِعْ سَبِيلَ مَنْ أَنَابَ إِلَيَّ

অর্থাৎ তবুও দুনিয়ায় তাদের সাথে সদ্ভাবে সহাবস্থান করতে থাকো। বরং মেনে চলো সে ব্যক্তির পথ যে আমার দিকে ফিরে এসেছে৷

এখানে ইসলামের একটি অনন্য ন্যায়নীতি শিক্ষা দেয়া হয়েছে। পিতা মাতা যদি শিরক করতে বাধ্য করেন, তবে তা মানা হারাম হয়ে যায়। এ অবস্থায় স্বভাবতঃ মানুষ সবসময় সীমার মধ্যে থাকতে পারেনা। এ সময় সন্তানের পক্ষ থেকে বাবা মা’র প্রতি কটু বাক্য প্রয়োগ, অশোভন আচরণের আশঙ্কা থেকে যায়। তাই ঐ মুহূর্তেও তাদের অনানুগত্যের পাশাপাশি সদাচরণের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। একই সাথে সেক্ষেত্রে হেদায়াতপ্রাপ্ত ব্যক্তির অনুসরণের আদেশ দেয়া হয়েছে।

ثُمَّ إِلَيَّ مَرْجِعُكُمْ فَأُنَبِّئُكُمْ بِمَا كُنتُمْ تَعْمَلُونَ

অর্থাৎ তারপর তোমাদের সবাইকে ফিরে আসতে হবে আমারই দিকে৷ সে সময় তোমরা কেমন কাজ করছিলে তখন তা আমি তোমাদেরকে জানিয়ে দেবো৷

এ দুনিয়ার আত্মীয়তা এবং আত্মীয়দের অধিকার কেবলমাত্র এ দুনিয়ার সীমা-ত্রিসীমা পর্যন্তই বিস্তৃত। সবশেষে পিতা-মাতা ও সন্তান সবাইকে তাদের স্রষ্টার কাছে ফিরে যেতে হবে। সেখানে তাদের প্রত্যেকের জবাবদিহি হবে তাদের ব্যক্তিগত দায়িত্বেও ভিত্তিতে। যদি পিতা-মাতা সন্তানকে পথভ্রষ্ট করে থাকে তাহলে তারা পাকড়াও হবে। যদি সন্তান পিতা-মাতার জন্য পথ ভ্রষ্টতা গ্রহণ করে থাকে তাহলে তাকে শাস্তি পেতে হবে। আর সন্তান যদি সঠিক পথ অবলম্বন করে থাকে এবং পিতা-মাতার বৈধ অধিকার আদায় করার ক্ষেত্রেও কোন প্রকার ত্রুটি না করে থাকে কিন্তু পিতা-মাতা কেবলমাত্র পথভ্রষ্টতার ক্ষেত্রে তাদের সহযোগী না হবার কারণে তাকে নির্যাতন করে থাকে, তাহলে তারা আল্লাহর পাকড়াও থেকে বাঁচতে পারবে না।

১৬ নং আয়াতের ব্যাখ্যা-

يَا بُنَيَّ إِنَّهَا إِنْ تَكُ مِثْقَالَ حَبَّةٍ مِنْ خَرْدَلٍ فَتَكُنْ فِي صَخْرَةٍ أَوْ فِي السَّمَوَاتِ أَوْ فِي الأَرْضِ يَأْتِ بِهَا اللَّهُ إِنَّ اللَّهَ لَطِيفٌ خَبِيرٌ

অর্থাৎ (আর লুকমান বলেছিল ) “ হে পুত্র! কোন জিনিস যদি সরিষার দানা পরিমাণও হয় এবং তা লুকিয়ে থাকে পাথরের মধ্যে , আকাশে বা যমিনের মধ্যে কোথাও , তাহলে আল্লাহ তাো বের করে নিয়ে আসবেন৷ কারণ তিনি সূক্ষ্মদর্শী এবং সবকিছু জানেন৷

এটি মহাত্মা লুক্বমানের দ্বিতীয় উপদেশ, যা আকাইদ সম্পর্কে। এতে বলা হচ্ছে, আল্লাহর জ্ঞান ও তার পাকড়াও এর বাইরে কেউ যেতে পারে না। পাথরের মধ্যে ছোট্ট একটি কণা দৃষ্টির অগোচরে থাকতে পারে কিন্তু তার কাছে তা সুস্পষ্ট । আকাশ মণ্ডলে একটি ক্ষুদ্রতম কণিকা তোমার থেকে বহু দূরবর্তী হতে পারে কিন্তু তা আল্লাহর বহু নিকটতর। ভূমির বহু নিম্ন স্তরে পতিত কোন জিনিস তোমার কাছে গভীর অন্ধকারে নিমজ্জিত । কিন্তু তার কাছে তা রয়েছে উজ্জ্বল আলোর মধ্যে। কাজেই তুমি কোথাও কোন অবস্থায়ও এমন কোন সৎ বা অসৎ কাজ করতে পারো না যা আল্লাহর অগোচরে থেকে যায়। তিনি কেবল তা জানেন তাই নয় বরং যখন হিসেব-নিকেশের সময় আসবে তখন তিনি তোমাদের প্রত্যেকটি কাজের ও নড়াচড়ার রেকর্ড সামনে নিয়ে আসবেন।

আল্লাহ্‌ পাক অন্যত্র বলছেন-

“আমি(কিয়ামতের দিন) ইনসাফের পাল্লা রেখে দিব। সুতরাং কোন নফসের প্রতি বিন্দুমাত্র যুলুম করা হবেনা”।(২১:৪৭)

আরেক জায়গায় তিনি বলেছেন-

“কেউ ধূলিকণা পরিমাণ ভালো কাজ করলে (কিয়ামতের দিন) তা দেখতে পাবে। আর কেউ ধূলিকণা পরিমাণ খারাপ কাজ করলে তাও দেখতে পাবে”।(৯৯:৭-৮)

কেউ কেউ বলেন- صَخْرَةٍ দ্বারা এমন পাথরকে বুঝানো হয়, যা ৭ স্তর মাটির নিচে থাকে। মূলত, পৃথিবীর অশ্মমণ্ডলের দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে যার প্রধান উপাদান কালো রংবিশিষ্ট গ্রানাইট পাথর।

হযরত আবু সাঈদ খুদরী(রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলে আকরাম(সাঃ) বলেছেন- যদি তোমাদের মধ্যে কোন লোক এমন কোন পাথরের মধ্যেও কোন আমল করে, যার কোন দরজা, জানালা এমনকি কোন ছিদ্রও নেই; তবুও আল্লাহ্‌ সেই আমল প্রকাশ করে দেবেন, তা ভালো কিংবা মন্দ হোক। (ইবনে কাসীর)

১৭ নং আয়াতের ব্যাখ্যা-

يَا بُنَيَّ أَقِمْ الصَّلاة

অর্থাৎ হে পুত্র! নামায কায়েম করো।

অতীব গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় হচ্ছে সালাত। মাক্কী ও মাদানী যুগে নাজিলকৃত বহু আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামিন সালাতের তাকিদ দিয়েছেন। আলোচ্য আয়াতটিতেও আমরা একই রূপ তাকিদ দেখতে পাই। পূর্ববর্তী সব নবী রাসুলই নামাজ আদায় করতেন, যদিও তা আদায়ের পদ্ধতি ছিল আলাদা আলাদা। মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) নবুওয়াত প্রদানের সঙ্গে সঙ্গেই জিবরিল (আ) কে পাঠিয়ে আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামিন তাঁকে সালাত আদায়ের পদ্ধতি শিখিয়ে দেন। এটি এমন এক প্রক্রিয়া যার অনুশীলন মুমিনদের মাঝে অনুপম নৈতিক শক্তি সৃষ্টি করে। যেমন আল্লাহ্‌ বলেন- “নিশ্চয়ই নামাজ সকল অশ্লীল ও খারাপ কাজ থেকে দূরে রাখে”।

নামাজ কায়েম করা অর্থ শুধু নামাজ পড়ে নেয়া নয়; বরং নামাজের যাবতীয় নিয়মাবলী পরিপূর্ণভাবে এবং সময়মত আদায় করা। অতঃপর এর উপর অবিচল থাকা।

وَأْمُرْ بِالْمَعْرُوفِ وَانْهَ عَنْ الْمُنكَرِ

অর্থাৎ সৎকাজের হুকুম দাও, খারাপ কাজে নিষেধ করো।

হাদিসে এসেছে, রাসুল(সাঃ) বলেছেন-

«من رأى منكم منكراً فليغيره بيده ، فإن لم يستطع فبلسانه ، فإن لم يستطع فبقلبه ، وذلك أضعف الإيمان»

অর্থ:

“তোমাদের কেউ যদি কোন অন্যায় কাজ সংঘটিত হতে দেখে, তখন সে তাকে তার হাত দ্বারা প্রতিহত করবে। আর যদি তা সম্ভব না হয়, তবে তার মুখ দ্বারা। আর তাও যদি সম্ভব না হয়, তাহলে সে অন্তর দিয়ে ঘৃণা করবে। আর এ হল, ঈমানের সর্বনিম্নস্তর।”

ِ وَاصْبِرْ عَلَى مَا أَصَابَكَ

অর্থাৎ যত বিপদই আসুক সে জন্য সবর করো৷

এর মধ্যে এদিকে একটি সূক্ষ্ণ ইঙ্গিত রয়েছে যে, সৎকাজের হুকুম দেয়া এবং অসৎকাজে নিষেধ করার দায়িত্ব যে ব্যক্তিই পালন করবে তাকে অনিবার্যভাবে বিপদ আপদের মুখোমুখি হতে হবে। এ ধরনের লোকের পেছনে দুনিয়া কোমর বেঁধে লেগে যাবে এবং সব ধরনের কষ্টের সম্মুখীন তাকে হতেই হবে।

সূরা আল ‘আনকাবুতের ২ ও ৩ নম্বর আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামিন বলেন,

اَحَسِبَ النَّاسُ اَنْ يُّتْرَكُوْآ اَنْ يَّقُوْلُوْآ امَنَّا وَهُمْ لاَ يُفْتَنُوْنَ 0 وَلَقَدْ فَتَنَّا الَّذِيْنَ مِنْ قَبْلِهِمْ فَلَيَعْلَمَنَّ اللهُ الَّذِيْنَ صَدَقُوْا وَلَيَعْلَمَنَّ الْكَاذِبِيْنَ0

‘লোকেরা কি মনে করেছে যে ‘আমরা ঈমান এনেছি’ এই কথা বললেই তাদেরকে ছেড়ে দেয়া হবে এবং তাদেরকে পরীক্ষা করা হবে না? অথচ তাদের পূর্ববর্তীদেরকে আমি পরীক্ষা করেছি। আল্লাহকে তো জানতে হবে ঈমানের দাবিতে কারা সত্যবাদী আর কারা মিথ্যাবাদী।’

সবর অতীব গুরুত্বপূর্ণ একটি গুণ। মুমিনদেরকে এই গুণে গুণান্বিত হওয়ার জন্য আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামিন বারবার তাকিদ করেছেন। আল হাদিসেও এই বিষয়ে তাকিদ রয়েছে।

রোগ-ব্যাধির কষ্ট বরদাশত করার নাম সবর।

দুঃখ-বেদনায় ভেঙে না পড়ার নাম সবর।

অনভিপ্রেত কথা ও আচরণে উত্তেজিত না হওয়ার নাম সবর।

পাপের পথে গিয়ে লাভবান হওয়ার চেয়ে পুণ্যের পথে থেকে ক্ষতিকে মেনে নেয়ার নাম সবর।

মিথ্যা প্রচারণার মুখে অবিচলিত থাকার নাম সবর।

ভীতিপ্রদ পরিস্থিতিতেও সঠিক পথে দৃঢ়পদ থাকার নাম সবর।

লক্ষ্য হাসিলের জন্য দুঃখ-কষ্ট সহ্য করার নাম সবর।

লক্ষ্য অর্জন বিলম্বিত হচ্ছে দেখে হতাশ বা নিরাশ না হওয়ার নাম সবর।

বিরোধিতার বীরোচিত মোকাবেলার নাম সবর। ইত্যাদি।

রাসূল সা. বলেন,

«المؤمن الذي يخالط الناس ويصبر على أذاهم ، أفضل من المؤمن الذي لا يخالط الناس ولا يصبر على أذاهم».

“যে ঈমানদার মানুষের সাথে উঠা-বসা ও লেনদেন করে এবং তারা যে সব কষ্ট দেয়. তার উপর ধৈর্য ধারণ করে, সে— যে মুমিন মানুষের সাথে উঠা-বসা বা লেনদেন করে না এবং কোন কষ্ট বা পরীক্ষার সম্মুখীন হয় না—তার থেকে উত্তম।”

إِنَّ ذَلِكَ مِنْ عَزْمِ الأُمُورِ

অর্থাৎ একথাগুলোর জন্য অবশ্যই জোর তাকিদ করা হয়েছে৷

এর দ্বিতীয় অর্থ হতে পারে, এটি বড়ই হিম্মতের কাজ। মানবতার সংশোধন এবং তার সংকট উত্তরণে সাহায্য করার কাজ কম হিম্মতের অধিকারী লোকদের পক্ষে সম্ভব নয়। এসব কাজ করার জন্য শক্ত বুকের পাটা দরকার।

১৮ নং আয়াতের ব্যাখ্যা-

وَلا تُصَعِّرْ خَدَّكَ لِلنَّاسِ

অর্থাৎ আর অহঙ্কারবশে মানুষকে অবজ্ঞা করোনা।

صَعِّر বলা হয় আরবী ভাষায় একটি রোগকে। এ রোগটি হয় উটের ঘাড়ে। এ রোগের কারণে উট তার ঘাড় সবসময় একদিকে ফিরিয়ে রাখে। এর মর্মার্থ এই যে, লোকের সাথে সাক্ষাত বা কথোপকথনের সময় মুখ ফিরিয়ে রেখোনা, যা তাদের প্রতি উপেক্ষা ও অবজ্ঞার নিদর্শন এবং শিষ্টাচার পরিপন্থী। এটি অহঙ্কারের প্রকাশ।

আল্লামা ইবনে কাসীর রহ. বলেন, ‘যখন তুমি কথা বল অথবা তোমার সাথে মানুষ কথা বলে, তখন তুমি মানুষকে ঘৃণা করে অথবা তাদের উপর অহংকার করে, তাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখবে না। তাদের সাথে হাস্যোজ্জ্বল হয়ে কথা বলবে। তাদের জন্য উদার হবে এবং তাদের প্রতি বিনয়ী হবে।’

কারণ, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

تبسمك في وجه أخيك لك صدقة .

“তোমার অপর ভাইয়ের সম্মুখে তুমি মুচকি হাসি দিলে, তাও সদকা হিসেবে পরিগণিত হবে।”

وَلا تَمْشِ فِي الأَرْضِ مَرَحاً

অর্থাৎ পৃথিবীর বুকে উদ্ধত ভঙ্গিতে চলো না।

এর মানে হচ্ছে, ক্ষমতাগর্বী ও অহংকারীদের মতো আচরণ করো না । এ নির্দেশটি ব্যক্তিগত কর্মপদ্ধতি ও জাতীয় আচরণ উভয়ের ওপর সমানভাবে প্রযোজ্য । এ নির্দেশের বদৌলতেই এ ঘোষণাপত্রের ভিত্তিতে মদীনা তাইয়েবায় যে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয় তার শাসকবৃন্দ, গভর্নর ও সিপাহসালারদের জীবনে ক্ষমতাগর্ব ও অহংকারের ছিঁটেফোটাও ছিল না । এমনকি যুদ্ধরত অবস্থায়ও কখনো তাদের মুখ থেকে দম্ভ ও অহংকারের কোন কথাই বের হতো না । তাদের ওঠা বসা, চাল চলন, পোশাক- পরিচ্ছদ, ঘর- বাড়ি, সওয়ারী ও সাধারণ আচার – আচরণের নম্রতা ও কোমলতা বরং ফকিরী ও দরবেশীর ছাপ স্পষ্ট দেখা যেতো । যখন তারা বিজয়ীর বেশে কোন শহরে প্রবেশ করতেন তখনও দর্প ও অহংকার সহকারে নিজেদের ভীতি মানুষের মনে বসিয়ে দেবার চেষ্টা করতেন না

আল্লাহ্‌ তায়ালা কোরআন শরীফের আরেক স্থানে বলেছেন-

“যমীনে দম্ভভরে চলাফেরা করোনা। যেহেতু না তুমি যমিনকে ধ্বংস করতে পারবে, না পাহাড়ের উচ্চতায় পৌঁছুতে পারবে”।(১৭:৩৭)

অহঙ্কারের পরিচয়ে রাসূল(সাঃ) বলেছেন- “অহঙ্কার এরই নাম যে, তুমি সত্যকে ঘৃণা করবে এবং লোকদেরকে তুচ্ছ জ্ঞান করবে”।

(ইবনে কাসীর)

إِنَّ اللَّهَ لا يُحِبُّ كُلَّ مُخْتَالٍ فَخُورٍ

অর্থাৎ আল্লাহ কোন দাম্ভিক ও অহংকারীকে পছন্দ করেন না৷

مُخْتَالٍ মানে হচ্ছে, এমন ব্যক্তি যে নিজেই নিজেকে কোন বড় কিছু মনে করে। আর فَخُورٍ তাকে বলে ,যে নিজের বড়াই করে অন্যের কাছে। মানুষের চালচলনে অহংকার, দম্ভ ও ঔদ্ধত্যের প্রকাশ তখনই অনিবার্য হয়ে উঠে , যখন তার মাথায় নিজের শ্রেষ্ঠত্বের বিশ্বাস ঢুকে যায় এবং সে অন্যদেরকে নিজের বড়াই ও শ্রেষ্ঠত্ব অনুভব করাতে চায়।

হাদিসে কুদসিতে আছে, রাসুল(সাঃ) বলেন- আল্লাহ্‌ বলেছেন,

১৯ নং আয়াতের ব্যাখ্যা-

وَاقْصِدْ فِي مَشْيِكَ

অর্থাৎ নিজের চালচলনে ভারসাম্য আনো।

কোন কোন মুফাসসির এর এই অর্থ গ্রহণ করেছেন যে, “দ্রুতও চলো না এবং ধীরেও চলো না বরং মাঝারি চলো।” কিন্তু পরবর্তী আলোচনা থেকে পরিষ্কার জানা যায়, এখানে ধীরে বা দ্রুত চলা আলোচ্য বিষয় নয়। ধীরে বা দ্রুত চলার মধ্যে কোন নৈতিক গুণ বা দোষ নেই এবং এ জন্য কোন নিয়মও বেঁধে দেয়া যায় না। কাউকে দ্রুত কোন কাজ করতে হলে সে দ্রুত ও জোরে চলবে না কেন। আর যদি নিছক বেড়াবার জন্য চলতে থাকে তাহলে এ ক্ষেত্রে ধীরে চলায় ক্ষতি কি ৷ মাঝারি চালে চলার যদি কোন মানদণ্ড থেকেই থাকে, তাহলে প্রত্যেক অবস্থায় প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য তাকে একটি সাধারণ নিয়মে পরিণত করা যায় কেমন করে ৷ আসলে এখানে উদ্দেশ্য হচ্ছে, প্রবৃত্তির এমন অবস্থার সংশোধন যার প্রভাবে চলার মধ্যে দম্ভ অথবা দীনতার প্রকাশ ঘটে। বড়াই করার অহমিকা যদি ভেতরে থেকে যায় তাহলে অনিবার্যভাবে তা একটি বিশেষ ধরনের চাল-চলনের মাধ্যমে বের হয়ে আসে। এ অবস্থা দেখে লোকটি যে কেবল অহংকারে মত্ত হয়েছে, একথাই জানা যায় না, বরং তার চাল-চলনের রং ঢং তার অহংকারের স্বরূপটিও তুলে ধরে। ধন-দওলত, ক্ষমতা-কর্তৃত্ব, সৌন্দর্য, জ্ঞান, শক্তি এবং এ ধরনের অন্যান্য যতো জিনিসই মানুষের মধ্যে অহংকার সৃষ্টি করে তার প্রত্যেকটির দম্ভ তার চাল-চলনে একটি বিশেষ ভঙ্গি ফুটিয়ে তোলে। পক্ষান্তরে চাল-চলনে দীনতার প্রকাশ ও কোন না কোন দূষণীয় মানসিক অবস্থার প্রভাবজাত হয়ে থাকে। কখনো মানুষের মনের সুপ্ত অহংকার একটি লোক দেখানো বিনয় এবং কৃত্রিম দরবেশি ও আল্লাহ প্রেমিকের রূপ লাভ করে এবং এ জিনিসটি তার চাল-চলনে সুস্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে। আবার কখনো মানুষ যথার্থই দুনিয়া ও তার অবস্থার মোকাবিলায় পরাজিত হয় এবং নিজের চোখে নিজেই হেয় হয়ে দুর্বল চালে চলতে থাকে। লুকমানের উপদেশের উদ্দেশ্য হচ্ছে, নিজের মনের এসব অবস্থার পরিবর্তন করো এবং একজন সোজা-সরল- যুক্তিসঙ্গত ভদ্রলোকের মতো চলো, যেখানে নেই কোন অহংকার ও দম্ভ এবং কোন দুর্বলতা, লোক দেখানো বিনয় ও ত্যাগ।

এ ব্যাপারে সাহাবায়ে কেরামের রুচি যে পর্যায়ের গড়ে উঠেছিল তা এ ঘটনাটি থেকেই অনুমান করা যেতে পারে। হযরত উমর (রা) একবার এক ব্যক্তিকে মাথা হেঁট করে চলতে দেখলেন। তিনি তাকে ডেকে বললেন, “মাথা উঁচু করে চলো। ইসলাম রোগী নয়।” আর একজনকে তিনি দেখলেন যে কুঁকড়ে চলছে। তিনি বললেন, “ওহে জালেম! আমাদের দীনকে মেরে ফেলছো কেন ৷ এ দুটি ঘটনা থেকে জানা যায় , হযরত উমরের কাছে দীনদারীর অর্থ মোটেই এটা ছিল না যে, পথ চলার সময় রোগীর মতো আচরণ করবে এবং অযথা নিজেকে দীনহীন করে মানুষের সামনে পেশ করবে। কোন মুসলমানকে এভাবে চলতে দেখে তার ভয় হতো, এভাবে চললে অন্যদের সামনে ইসলামের ভুল প্রতিনিধিত্ব করা হবে এবং মুসলমানদের মধ্যেই নিস্তেজ ভাব সৃষ্টি হয়ে যাবে। এমনি ঘটনা হযরত আয়েশার (রা) ব্যাপারে একবার ঘটে। তিনি দেখলেন একজন লোক কুঁকড়ে মুকড়ে রোগীর মতো চলছে। জিজ্ঞেস করলেন, কি হয়েছে ৷ বলা হলো, ইনি একজন কারী (অর্থাৎ কুরআন অধ্যয়ন ও অধ্যাপনা করেন এবং শিক্ষাদান ও ইবাদত করার মধ্যে মশগুল থাকেন) এ কথা শুনে হযরত আয়েশা (রা) বললেন, “উমর ছিলেন কারীদের নেতা। কিন্তু তার অবস্থা ছিল, পথে চলার সময় জোরে জোরে হাঁটতেন। যখন কথা বলতেন, জোরে জোরে বলতেন। যখন মারধর করতেন খুব জোরেশোরে মারধর করতেন।”

কিন্তু চিন্তার বিষয় হচ্ছে , মানুষের চলার মধ্যে এমন কি গুরুত্ব আছে যে কারণে এই বিষয়ে তাকিদ দেয়া হয়েছে ৷ এ প্রশ্নটিকে যদি একটু গভীর দৃষ্টিতে বিশ্লেষণ করা হয় তাহলে বুঝা যায় যে , মানুষের চলা শুধুমাত্র তার হাঁটার একটি ভংগীর নাম নয় বরং আসলে এটি হয় তার মন-মানস , চরিত্র ও নৈতিক কার্যাবলীর প্রত্যক্ষ প্রতিফলন। একজন আত্মমর্যাদা সম্পন্ন ব্যক্তির চলা , একজন গুণ্ডা ও বদমায়েশের চলা , একজন স্বৈরাচারী ও জালেমের চলা , একজন আত্মম্ভরী অহংকারীর চলা , একজন সভ্য-ভব্য ব্যক্তির চলা , একজন দরিদ্র-দীনহীনের চলা এবং এভাবে অন্যান্য বিভিন্ন ধরনের লোকদের চলা পরস্পর থেকে এত বেশী বিভিন্ন হয় যে, তাদের প্রত্যেককে দেখে কোন ধরনের চলার পেছনে কোন ধরনের ব্যক্তিত্ব কাজ করছে তা সহজেই অনুমান করা যেতে পারে। এ কারণেই লুক্বমানের উপদেশের মধ্যে এই বিষয়টি উঠে এসেছে।

وَاغْضُضْ مِنْ صَوْتِكَ

অর্থাৎ এবং কণ্ঠস্বর নীচু করো৷

যার মানে হল, কণ্ঠস্বরকে প্রয়োজনাতিরিক্ত উচ্চ করা যাবেনা এবং হট্টগোল করা যাবেনা।

হযরত হুসাইন(রাঃ) বর্ণনা করেন, আমি আমার পিতা আলী(রাঃ) কে রাসুলুল্লাহ(সাঃ) এর মানুষের সাথে উঠাবসা, মেলামেশার সময় তাঁর আচার ব্যবহার ও প্রকৃতি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করায় তিনি বললেন- নবীজি(সাঃ) সবসময় প্রসন্ন ও হাস্যোজ্জ্বল মনে হত; তাঁর চরিত্রে নম্রতা এবং আচার ব্যবহারে বিনয় বিদ্যমান ছিল। তাঁর স্বভাব মোটেই রুক্ষ ছিলনা, কথাবার্তাও নিরস ছিলনা। তিনি উচ্চস্বরে বা অশ্লীল কথা বলতেননা, কারো প্রতি দোষারোপও করতেননা। কৃপণতা প্রকাশ করতেননা। যেসব জিনিস মনপুত না হত, সেগুলোর প্রতি আসক্তি প্রকাশ করতেননা। কিন্তু (সেগুলো হালাল হলে, তার প্রতি কারো আকর্ষণ থাকলে) তা থেকে কাউকে নিরাশ করতেননা এবং সে সম্পর্কে কোন মন্তব্যও করতেননা, তিনটি বিষয় তিনি সবসময় পরিহার করতেন- ঝগড়া বিবাদ, অহঙ্কার এবং অপ্রয়োজনীয় ও অর্থহীন কাজে আত্মনিয়োগ করা।(শামায়েলে তিরমিজী)

إِنَّ أَنكَرَ الأَصْوَاتِ لَصَوْتُ الْحَمِيرِ

অর্থাৎ নিঃসন্দেহে গাধার আওয়াজই সব আওয়াজের মধ্যে সবচেয়ে অপ্রীতিকর৷

এর মানে এ নয় যে, মানুষ সবসময় আস্তে নীচু স্বরে কথা বলবে এবং কখনো জোরে কথা বলবে না। বরং গাধার আওয়াজের সাথে তুলনা করে কোন ধরনের ভাব-ভঙ্গিমা ও কোন ধরনের আওয়াজে কথা বলা থেকে বিরত থাকতে হবে তা পরিষ্কার করে বলে দেয়া হয়েছে। ভঙ্গী ও আওয়াজের এক ধরনের নিম্নগামিতা ও উচ্চগামিতা এবং কঠোরতা ও কোমলতা হয়ে থাকে স্বাভাবিক ও প্রকৃত প্রয়োজনের খাতিরে। যেমন কাছের বা কম সংখ্যক লোকের সাথে কথা বললে আস্তে ও নীচু স্বরে বলবেন। দূরের অথবা অনেক লোকের সাথে কথা বলতে হলে অবশ্যই জোরে বলতে হবে। উচ্চারণভঙ্গীর ফারাকের ব্যাপারটাও এমনি স্থান-কালের সাথে জড়িত। প্রশংসা বাক্যের উচ্চারণভঙ্গী নিন্দা বাক্যের উচ্চারণভঙ্গী থেকে এবং সন্তোষ প্রকাশের কথার ঢং এবং অসন্তোষ প্রকাশের কথার ঢং বিভিন্ন হওয়াই উচিত। এ ব্যাপারটা কোন অবস্থায়ই আপত্তিকর নয়। হযরত লুকমানের নসীহতের অর্থ এ নয় যে, এ পার্থক্যটা উঠিয়ে দিয়ে মানুষ সবসময় একই ধরনের নীচু স্বরে ও কোমল ভঙ্গীমায় কথা বলবে। আসলে আপত্তিকর বিষয়টি হচ্ছে অহংকার প্রকাশ, ভীতি প্রদর্শন এবং অন্যকে অপমানিত ও সন্ত্রস্ত করার জন্য গলা ফাটিয়ে গাধার মতো বিকট স্বরে কথা বলা।

হযরত আবু হুরায়রা(রাঃ) থেকে বর্ণিত, নবী করীম(সাঃ) বলেছেন-

»إذا سمعتم أصوات الديكة ، فسلوا الله من فضله ، فإنها رأت ملكاً ، وإذا سمعتم نهيق الحمار فتعوذوا بالله من الشيطان ، فإنها رأت شيطاناً» .

যখন তোমরা মোরগের ডাক শুনবে, তখন আল্লাহ্‌ তায়ালার কাছে অনুগ্রহ প্রার্থনা করবে। আর যখন গাধার ডাক শুনবে, তখন শয়তানের কাছ থেকে তাঁর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করবে। কেননা সে শয়তানকে দেখতে পায়। (নাসাঈ)

শিক্ষাঃ

১) এসব জ্ঞানগর্ভ উপদেশসমুহের সর্বাগ্রে হল আকীদার পরিচ্ছন্নতা সম্পর্কে- আল্লাহ্‌ তায়ালার সাথে কাউকে শরীক করা যাবেনা। মাতা পিতার সাথে সদ্ব্যবহার ও তাদের আনুগত্য করা ফরজ। তবে তারা যদি শিরক করতে বাধ্য করতে করতে চান, তবে সে কথা মানা হারাম হয়ে যাবে। তথাপি দুর্ব্যবহার না করে সাধ্যমত ভালো আচরণ করতে হবে।

২) দ্বিতীয় উপদেশ আকাইদ সম্পর্কে- মহাবিশ্বের প্রতিটি বস্তুকণা আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামিনের আওতাধীন। তিনি চাইলে কাছের দূরের যে কোন বিষয় আমাদের সামনে নিয়ে আসতে পারেন, যেমনটি তিনি বিচার দিবসে করবেন।

৩) তৃতীয় উপদেশ কর্মের পরিশুদ্ধতা সম্পর্কে- নামাজ প্রতিষ্ঠা করা।

৪) চতুর্থ উপদেশ চরিত্র সংশোধন সম্পর্কে- সৎ কাজের আদেশ ও খারাপ কাজে বাঁধা দেয়া, বিপদে ধৈর্য ধারণ করা।

৫) পঞ্চম উপদেশ সামাজিক শিষ্টাচার সম্পর্কে- কোন মানুষকে অবজ্ঞা করা যাবেনা, চলাফেরায় কথা বার্তায় অহঙ্কার প্রকাশ করা যাবেনা, সংযতভাবে কথা বলতে হবে।

Leave a comment