এক জন স্বামী একজন স্ত্রীর পৃথিবী ।

পারভীন সুলতানা

এক জন পুরুষ যখন বাবা হন ।

তখন তার হৃদয় রাজ্যের বিশাল রাজ প্রাসাধে থাকে একটা মেয়ে রাজকুমারীর মতো বাবার হৃদয় জুড়ে থাকে । বাবা বন্ধুর মত মেয়ের মনের না বলা কথা গূলো না বললেও বুঝে ফেলেন।ইসলামের আলোকে মেয়েকে গড়ে তুলে দুনিয়া ওঁ আখিরাতে জান্নাতের ঠিকানা তৈরী করে নেন।

এক জন পুরুষ যখন ভাই হন ।

তখন সেই ভাইটির হৃদয়ে একটি বোনের জন্য সেই ভাইটি অতি প্রিয় অতি আপনজন হয়ে যায় । বোনটির সকল মঙ্গল জনক কর্মগুলি সে বোনের মাঝে সৃষ্টি করে তার সুখে নিজে সুখি।

এক জন পুরুষ যখন মুমিন মুত্তাকিন বন্ধু হন ।

তিনি ইসলামের আলো ছড়ানোর সময় দ্বীনি বোন দের কেও সেই আলোকে আলোকিত করেন। নিজের জানের ক্ষতি হোক তাও তার দ্বীনি বোনদের ইজ্জত আব্রুর ক্ষতি মেনে নিতে পারেন না । তাদের এই ভালবাসার বন্ধন শুধু আল্লাহ সন্তুষ্টির জন্য ।অন্য কোন স্বার্থে নয়।

এক জন পুরুষ যখন ছেলে হন

তখন সে একজন মায়ের নয়নমনি ,কলিজার টুকরা মায়ের নাড়ি ছিড়া রাজকুমার । আর সেই মা তার জন্য দুনিয়া ওঁ আখিরাতের জান্নাত।যেই সন্তানের হৃদয়ের কষ্ট কেউ না জানতেই আগে জানেন মা।গর্ভে থেকে বয়স্ক হলেওঁ সে মায়ের কাছে থাকে সব সময় একটা ছোট খোকা ।

এক জন পুরুষ যখন স্বামী হন ।

তখন তিনি হয়ে যান একজন নারীর পৃথিবী।পৃথিবীতে এতো সুখ নেই যা স্বামীর মধু মিশ্রিত ভালবাসায় আছে। সে স্ত্রীর মনের সিংহআসন দখল করে সারা চিরস্তায়ী রাজা হয়ে যায় । ভালবাসার সুঘ্রানের ফুলের রেনু ছড়ায়ে নারীর সারা অঙ্গে ছড়ায়ে ফুল ফাগুনের খেলায় বিভোর করে রাখে । তখন একজন নারী চিৎকার করে বলে উঠতে ইচ্ছে করে নাইবা থাকুক দেশে আমিই রাজরানী ।

একজন পুরুষ একজন নারীকে কত ভালবাসে তা সে অনেক সময় অমৃত প্রানের তৃপ্তির মত বুঝাতে পারবে না। একই খাচার মাঝে দুই পাখি প্রান এক হয়ে যায় । সেই খাচা ভেঙ্গে একজন বের হতে চাইলে আরেক জন এর প্রান টা কেড়ে নিয়ে যায় । চোখের মনি চোখে না থাকলে চোখ কি আলো পায় ।জীবন টা অন্ধকারে হাতড়ায়ে মরে। একা একা অন্ধকারে পথ চলা দুই জনের জন্য দুর্ভিসহ হয়ে যায় । কারন স্বামী স্ত্রী কে আল্লাহ একে অপরের পোষাকের বানিয়েছেন। একজন স্বামী ভালবাসার নাটাই ঠিক ঘূরাটে জানলে কখন নারীদের মন ঘুড়িটা অন্যের নাটাইয়ের ঘুড়ির সাথে প্যাচ খায় না আর ভ ালবাসার বন্ধন থেকে ছুটে যায় না ।

আজ আমার একমাত্র ভাইছা বোনকে নেওয়ার তারিখ করল । ভাইছা বোনের স্বামী থেকে অনুমতি নিল অনেক বুঝায়ে ,আমিও মহানগর মহিলা বিভাগীয় সেক্রেটারীর অনুমতি নিলাম । আমার দায়িত্ত অন্যদের বুঝায়ে দিলাম। কিন্তু আমার যাবার দিন যত এগিয়ে যাচ্ছে আমার পৃথিবীর আকাশে তত কালো মেঘের ঘনঘটা ঝড় হয়ে লাগল। গতকাল যেই মানুষ চেম্বার থেকে রাতে আসে সেই মানুষ ৩টায় এসে ডুকেই “পারুমনি ,আমার পক্ষে এক ঘন্টার জন্যওঁ তোমাকে দেশে যেতে পারব না ।আমি তোমার ভাইছা মানা করে দিয়েছি ।তুমি বোকা রয়ে গেলে ।তুমি বুঝোনা কেন আমার মানিবেগে ৩৩ বছর থেকে তোমার ছবি রাখি ।বুঝনা বাসায় এসে তোমাকে না দেখলে আমার কি অবস্থ্যা হবে । আমার কলিজা ব্যাথা করেছে । যতবার আমি ভেবেছি আমি ঘরে ডুকে আমার বঊ এর হাস্যোজ্জল চেহারা দেখব না। না আমি এটা সইতে পারব না ।ভাইছা আমার মনের অবস্থ্যা বুঝেছে তাই তিনি তোমাকে নিতে আসবে না বলেছে। ”

মায়ের কবরের কাছে দাড়ানো আর বাবার বাড়ির বেড়ানো জন্য আমার গোছানো ব্যগটা খুলে সব আবার রেখে দিতে প্রথম কষ্ট লাগলে পরে মনকে শান্তনা দিলাম ।আমার ভালবাসার পৃথিবী ছেড়ে আমি অন্য কোথাও গিয়ে কি আমি সুখি হতে পারব ।আল্লাহ আমার জন্য এতো বড় সুখের জান্নাত দুনিয়াতে রেখেন আর আমি সেই জান্নাত পেলে কোথায় যাবো ?আল্লাহ কি আমাকে মাফ করবেন ?আমি জানি না ।আমার ৩৩ বছরের দাম্পত্য জীবনে আমি বাবার বাড়ি বেড়াতে তাকে নিয়ে দুই /এক ঘন্টা ছাড়া তাকে রেখে আমি কোন দিন বেড়াতে যেতে পারি নাই । কারন এই ভালবাসার পৃথিবীটা আমাকে সারা ক্ষন ভালবাসার মাধুবী লতা দীয়ে আমার হৃদয়টা কে ঝড়ায়ে রেখেছেন । আমি এই ভালবাসার প্রাচীর ভেঙ্গে বের হতে পারি নি ।মা মন খারাপ করলে বলতাম ,মা আমি যদি স্বামীর কাছে সুখে থাকি তাতেই তুমি সুখি থাক।

আমার আজ কোন ব্যাথা বা কষ্ট নিয়ে এই লিখা নয় ।আমার লিখাটা হোলো আমাদের হাতের কাছে জান্নাত দুনিয়াতে দাম্পত্য সুখের মাঝে । আপনি পুরুষ নানা্নরুপে । তাই বলে আপনি শাসিত আর শোষিত না হয়ে আপনাকে সবাই বন্ধু হিসাবে পেলে সবাই সুখি । আমরা মেয়েরা আপনাদের সুভাকাঙ্গি , শত্রু নয়। আমাদের থেকে পুরুষদের কাছে সমাজের পরিবারের শান্তির চাবিকাঠি ।আপনি মেয়েদের রোবট না ভেবে একজন মানুষ ভাবেন । ভালবাসার স্বপ্ন দীয়ে সবার মাঝে একটা শান্তির বন্যা প্রবাহিত করতে পারেন । আপনার ভালবাসার সাগরের উত্তাল ঢেউ এর তোড়ে মা বোন স্ত্রী সবাই জান্নাতী সুখে হাবুডুবু খাবে।

আপনি পুরুষ হয়ে যখন মা ,বোন ,স্ত্রী মেয়ে এদের কে ইসলামের আলোকে পরিচালিৎ না করে তাদের সবাইকে অন্ধকারে ঢেলে দেন ।আর তারা অন্যায়ের সাগরে আপনাকে নিয়েই ভাসতে থাকে তখন আর আপনাদের মেয়েদের ভাল লাগে না । মা বাবার হয় বিচ্ছেদ। বোন যায় বিজ্ঞাপনের পন্য হয়ে । স্ত্রী যায় আপনার ক্লোজ বন্ধুর সাথে পরোকীয়ায় মত্ত হয়ে । মেয়ে হয়ে যায় ঐশী হয়ে আপনার গলায় বা মায়ের গলায় চুরী চালায়ে হত্যা কারী । না হয় ভালবাসা দিবসের সোনার ছেলেদের ধর্ষনের সেঞ্চুরীর স্বীকার ।

আমি বলব, এই সব কিছুর জন্য আপনি পুরুষ নামের কাপুরুষ হওযায় জন্য দায়ী । গুনে কাঠ খায় আস্তে আস্তে এক সময় পুরো ঘর খেয়ে পেলে ,তেমনি আপনার অইসলামীক কার্যকলাপ এর কারনেই আজ কের সমাজের গুনে ধরেছে ।আপনি সঠিক কর্নধার হলে আজ আপনার জন্যি সমাজে কিছু সামাজিক সভ্যতা সংঙ্কৃতি উন্নতি হত । হাজার মেয়ে নারী নির্যাতন থেকে বেচে যেত । সুমনের মা সুমনের আর তার বউ খাবার না দীয়ে দীয়ে কান্না করে ঘর ছেড়ে এসে বলত না , পারভিন আপা ,সুমনের বাবা আরেক বিয়ে করার পর ভেবেছি সুমন আসে তাকে বুকে রেখে বড় করলে সেই আমার দুখীর অন্ধের যষ্ঠী হয়ে কাজ করে খাওয়াবে ।তাই আর যৌবনে ভাইরা বিয়ে বসতে বলাতেও বিয়ে বসিনি । এখন কেন মনে হচ্ছে তখন কি ভুল করেছি লাম। সুমি এসে বলে , খালাম্মা আমি বাদল কে ভালবেসে বিয়ে করে মা বাবার বাড়ি হারালাম ।তাতে দুখ করিনী বাদল পাশে আছে ভেবে। এখন সেই বাদলের প্রচন্ড অত্যাচারের আঘাতে আমার দুই টি চোখ হারাতে হয়েছে । পারভীন খালাম্মা , বলেন তো আমার ছেলে কেমন দেখ তে ,সবাই বলে অনেক সুনদর । খালাম্মা কোথায় ভর্তি করলে সে বাদলের মত হবে না । মা বউ সবাইকে সমান অধিকার দীয়ে ভালবাসবে ।

আমার কষ্ট হয় এই সমাজের মেয়েদের কষ্ট দেখে ।তাতে নিজেকে পাপী মনে হয় । মনে হয় ইসলামের দাওয়াত সবার ঘরে পোছে দিতে পারি নাই বলে আজ আমারদের সমাজ তসলিমা নাসরিন ,তানিয়া আমিন রা ভরে যাচ্ছে। কেন তাও আমরা ঘরে বসে আসি ।

আপনি আল্লাহর একত্ববাদে বিশ্বাসী পুরুষ হন , আমাদের ওঁ পরিবারের সমাজের ভিতর থেকে নাস্তিক ওঁ মুনাফিকত্ব মনোভাব বর্জন করি। ঐক্য বদ্ধ ভাবে সমাজের অন্যায় অবিচার শোষন জুলুম নির্যাতন বন্ধ করে আল্লাহর বিধান মোতাবেক আমাদের সমাজের সভ্যতা ওঁ সংস্কৃতি গড়ে তুলি আর আমরা পরিপূর্ণ ঈমানদার হিসাবে উত্তম চরিত্র অর্জন করা

আল্লাহ আমাদের দুনিয়া ওঁ আখিরাতের সকল কল্যান লাভ করার তাওফিক দান করুন ।আমাদের স্বামী /স্ত্রী ছেলে মেয়েদের মুত্তাকিনদের ইমাম বানিয়ে আমাদের কে মুত্তাকিনদের নেতা বানিয়ে দিন । আমীন ।

অনেক দিন পরে লিখায় হাত দিয়েছি তাই কোন ভুল বা বেয়াদপি হলে ক্ষমা প্রাথী।

কুর‘আন ও সহিহ হাদীস থেকে কিছু দো‘আ

• কুরআনের নির্বাচিত দো‘আ:

رَبَّنَا آتِنَا فِي الدُّنْيَا حَسَنَةً وَفِي الآخِرَةِ حَسَنَةً وَقِنَا عَذَابَ النَّارِ
১। হে আমাদের প্রভু! দুনিয়াতে আমাদের কল্যাণ দাও এবং আখিরাতেও কল্যাণ দাও। আর আগুনের আযাব থেকে আমাদেরকে বাঁচাও।

رَبَّنَا لا تُؤَاخِذْنَا إِنْ نَسِيْنَا أَوْ أَخْطَأْنَا رَبَّنَا وَلا تَحْمِلْ عَلَيْنَا إِصْراً كَمَا حَمَلْتَهُ عَلَى الَّذِيْنَ مِنْ قَبْلِنَا رَبَّنَا وَلا تُحَمِّلْنَا مَا لا طَاقَةَ لَنَا بِهৃ وَاعْفُ عَنَّا وَاغْفِرْ لَنَا وَارْحَمْنَآ أَنْتَ مَوْلانَا فَانْصُرْنَا عَلَى الْقَوْمِ الْكَافِرِينَ
২। হে আমাদের রব! যদি আমরা ভুলে যাই কিংবা ভুল করি তবে তুমি আমাদেরকে পাকড়াও করো না।
হে আমাদের রব! পূর্ববর্তীদের উপর যে গুরুদায়িত্ব তুমি অর্পণ করেছিলে সে রকম কোন কঠিন কাজ আমাদেরকে দিও না।
হে আমাদের রব! যে কাজ বহনের ক্ষমতা আমাদের নেই এমন কাজের ভারও তুমি আমাদের দিও না। তুমি আমাদের মাফ করে দাও, আমাদের ক্ষমা কর। আমাদের প্রতি রহম কর। তুমি আমাদের মাওলা। অতএব কাফের সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে তুমি আমাদেরকে সাহায্য কর।[১]

رَبَّنَا لا تُزِغْ قُلُوبَنَا بَعْدَ إِذْ هَدَيْتَنَا وَهَبْ لَنَا مِنْ لَدُنْكَ رَحْمَةً إِنَّكَ أَنْتَ الْوَهَّابُ
৩। হে আমাদের রব! যেহেতু তুমি আমাদেরকে হেদায়াত করেছ, কাজেই এরপর থেকে তুমি আমাদের অন্তরকে বক্র করিও না। তোমার পক্ষ থেকে আমাদেরকে রহমত দাও। তুমিতো মহাদাতা।[২]

رَبِّ هَبْ لِي مِنْ لَدُنْكَ ذُرِّيَّةً طَيِّبَةً إِنَّكَ سَمِيعُ الدُّعَاءِ
৪। হে আমার পরওয়ারদেগার! তোমার কাছ থেকে আমাকে তুমি উত্তম সন্তান-সন্ততি দান কর। নিশ্চয়ই তুমিতো মানুষের ডাক শোনো।[৩]

رَبَّنَا اغْفِرْ لَنَا ذُنُوبَنَا وَإِسْرَافَنَا فِي أَمْرِنَا وَثَبِّتْ أَقْدَامَنَا وَانْصُرْنَا عَلَى الْقَوْمِ الْكَافِرِينَ
৫। হে আমাদের রব! আমাদের গুনাহগুলো মাফ করে দাও। যেসব কাজে আমাদের সীমালঙ্ঘন হয়ে গেছে সেগুলোও তুমি ক্ষমা কর। আর (সৎপথে) তুমি আমাদের কদমকে অটল রেখো এবং কাফের সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে তুমি আমাদেরকে সাহায্য কর।[৪]

رَبَّنَا وَآتِنَا مَا وَعَدْتَنَا عَلٰى رُسُلِكَ وَلاَ تُخْزِنَا يَوْمَ الْقِيَامَةِ إِنَّكَ لاَ تُخْلِفُ الْمِيعَادَ
৬। হে রব! নবী-রাসূলদের মাধ্যমে তুমি যে পুরস্কারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছো তা তুমি আমাদেরকে দিয়ে দিও। আর কিয়ামতের দিন আমাদেরকে তুমি অপমানিত করিও না। তুমিতো ওয়াদার বরখেলাফ কর না।[৫]

رَبَّنَا آمَنَّا بِمَا أَنْزَلْتَ وَاتَّبَعْنَا الرَّسُولَ فَاكْتُبْنَا مَعَ الشَّاهِدِينَ
৭। হে আমাদের রব! তুমি যা কিছু নাযিল করেছো, তার উপর আমরা ঈমান এনেছি। আমরা রাসূলের কথাও মেনে নিয়েছি। কাজেই সত্য স্বীকারকারীদের দলে আমাদের নাম লিখিয়ে দাও।

رَبَّنَا ظَلَمْنَا أَنْفُسَنَا وَإِنْ لَمْ تَغْفِرْ لَنَا وَتَرْحَمْنَا لَنَكُونَنَّ مِنَ الْخَاسِرِينَ
৮। হে আমাদের রব! আমরা নিজেদের উপর যুলম করেছি। এখন তুমি যদি আমাদের ক্ষমা না কর, আর আমাদের প্রতি রহম না কর তাহলে নিশ্চিতই আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যাব।

رَبَّنَا لا تَجْعَلْنَا مَعَ الْقَوْمِ الظَّالِمِينَ
৯। হে রব! আমাদেরকে জালিম সম্প্রদায়ের সাথী করিও না।[৮]

رَبِّ اجْعَلْنِي مُقِيمَ الصَّلاةِ وَمِنْ ذُرِّيَّتِي رَبَّنَا وَتَقَبَّلْ دُعَاূءِ
১০। হে আমার মালিক! আমাকে সালাত কায়েমকারী বানাও এবং আমার ছেলে-মেয়েদেরকেও নামাযী বানিয়ে দাও। হে আমার মালিক! আমার দোয়া তুমি কবুল কর।

رَبَّنَا اغْفِرْلِي وَلِوَالِدَيَّ وَلِلْمُؤْمِنِينَ يَوْمَ يَقُومُ الْحِسَابُ
১১। হে আমাদের পরওয়ারদেগার! যেদিন চূড়ান্ত হিসাব-নিকাশ হবে সেদিন তুমি আমাকে, আমার মাতা-পিতাকে এবং সকল ঈমানদারদেরকে তুমি ক্ষমা করে দিও।

رَبَّنَا آتِنَا مِنْ لَدُنْكَ رَحْمَةً وَهَيِّئْ لَنَا مِنْ أَمْرِنَا رَشَداً
১২। হে আমাদের রব! তোমার অপার অসীম করুণা থেকে আমাদেরকে রহমত দাও। আমাদের কাজগুলোকে সঠিক ও সহজ করে দাও।

قَالَ رَبِّ اشْرَحْ لِي صَدْرِي – وَيَسِّرْ لِيْ أَمْرِي -وَاحْلُلْ عُقْدَةً مِنْ لِسَانِيْ – يَفْقَهُوا قَوْلِيْ
১৩। হে আমার রব! আমার বক্ষকে তুমি প্রশস্ত করে দাও। আমার কাজগুলো সহজ করে দাও। জিহ্বার জড়তা দূর করে দাও, যাতে লোকেরা আমার কথা সহজেই বুঝতে পারে।

رَبِّ زِدْنِي عِلْماً
১৪। হে রব! আমার জ্ঞান বৃদ্ধি করে দাও।

رَبِّ لاَ تَذَرْنِيْ فَرْداً وَأَنْتَ خَيْرُ الْوَارِثِينَ
১৫। হে রব! আমাকে তুমি নিঃসন্তান অবস্থায় রেখো না। তুমিতো সর্বোত্তম মালিকানার অধিকারী।

رَبِّ أَعُوذُ بِكَ مِنْ هَمَزَاتِ الشَّيَاطِينِ – وَأَعُوْذُ بِكَ رَبِّ أَنْ يَحْضُرُونِ
১৬। হে রব! শয়তানের কুমন্ত্রণা থেকে আমি তোমার নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করি। আমি এ থেকেও তোমার নিকট পানাহ চাই যে, শয়তান যেন আমার ধারে কাছেও ঘেষতে না পারে।

رَبَّنَا اصْرِفْ عَنَّا عَذَابَ جَهَنَّمَ إِنَّ عَذَابَهَا كَانَ غَرَاماً ু إِنَّهَا سَاءَتْ مُسْتَقَرّاً وَّمُقَاماً
১৭। হে আমাদের রব! জাহান্নামের আযাব থেকে আমাদেরকে বাঁচিয়ে দিও। এর আযাব তো বড়ই সর্বনাশা। আশ্রয় ও বাস্থান হিসেবে এটা কতই না নিকৃষ্ট স্থান।

رَبَّنَا هَبْ لَنَا مِنْ أَزْوَاجِنَا وَذُرِّيَّاتِنَا قُرَّةَ أَعْيُنٍ وَّاجْعَلْنَا لِلْمُتَّقِينَ إِمَاماً
১৮। হে আমাদের রব! তুমি আমাদেরকে এমন স্ত্রী-সন্তান দান কর যাদের দর্শনে আমাদের চক্ষুশীতল হয়ে যাবে। তুমি আমাদেরকে পরহেযগার লোকদের ইমাম (অভিভাবক) বানিয়ে দাও।

رَبِّ هَبْ لِيْ حُكْماً وَأَلْحِقْنِي بِالصَّالِحِيْنَ – وَاجْعَلْ لِيْ لِسَانَ صِدْقٍ فِي الآخِرِينَ – وَاجْعَلْنِيْ مِنْ وَرَثَةِ جَنَّةِ النَّعِيمِ – وَلا تُخْزِنِيْ يَوْمَ يُبْعَثُوْنَ
১৯। হে রব! আমাকে জ্ঞান-বুদ্ধি দান কর এবং আমাকে নেককার লোকদের সান্নিধ্যে রেখো।
এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে আমার সুখ্যাতি চলমান রেখো।
আমাকে তুমি নিয়ামতে ভরা জান্নাতের বাসিন্দা বানিয়ে দিও।
যেদিন সব মানুষ আবার জীবিত হয়ে উঠবে সেদিন আমাকে তুমি অপমানিত করো না।

رَبِّ أَوْزِعْنِي أَنْ أَشْكُرَ نِعْمَتَكَ الَّتِي أَنْعَمْتَ عَلَيَّ وَعَلَى وَالِدَيَّ وَأَنْ أَعْمَلَ صَالِحاً تَرْضَاهُ وَأَدْخِلْنِي بِرَحْمَتِكَ فِي عِبَادِكَ الصَّالِحِينَ
২৩। হে প্রতিপালক! তুমি আমার ও আমার মাতা-পিতার প্রতি যে নিয়ামত দিয়েছো এর শোকরগোজারী করার তাওফীক দাও এবং আমাকে এমন সব নেক আমল করার তাওফীক দাও যা তুমি পছন্দ কর। আর তোমার দয়ায় আমাকে তোমার নেক বান্দাদের মধ্যে শামিল করে দাও।

رَبِّ انْصُرْنِي عَلَى الْقَوْمِ الْمُفْسِدِينَ
২৪। হে রব! ফাসাদ সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে তুমি আমাকে সাহায্য কর।

رَبِّ هَبْ لِي مِنَ الصَّالِحِينَ
২৫। হে রব! আমাকে তুমি নেককার সন্তান দান কর।

رَبِّ أَوْزِعْنِي أَنْ أَشْكُرَ نِعْمَتَكَ الَّتِي أَنْعَمْتَ عَلَيَّ وَعَلَى وَالِدَيَّ وَأَنْ أَعْمَلَ صَالِحاً تَرْضَاهُ وَأَصْلِحْ لِي فِي ذُرِّيَّتِي
২৬। হে রব! তুমি আমার ও আমার মাতা-পিতার প্রতি যে নিয়ামত দিয়েছ এর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার তাওফীক দাও এবং আমাকে এমন সব নেক আমল করার তাওফীক দাও যা তুমি পছন্দ কর। আর আমার ছেলে-মেয়ে ও পরবর্তী বংশধরকেও নেককার বানিয়ে দাও।

رَبَّنَا اغْفِرْ لَنَا وَلإِخْوَانِنَا الَّذِينَ سَبَقُونَا بِالإِيْمَانِ وَلا تَجْعَلْ فِي قُلُوبِنَا غِلاًّ لِلَّذِينَ آمَنُوا رَبَّنَا إِنَّكَ رَؤُوفٌ رَحِيْمٌ
২৭। হে আমাদের মালিক! তুমি আমাদের মাফ করে দাও। আমাদের আগে যেসব ভাইয়েরা ঈমান এনেছে, তুমি তাদেরও মাফ করে দাও। আর ঈমানদার লোকদের প্রতি আমাদের অন্তরে হিংসা-বিদ্বেষ সৃষ্টি করে দিও না। হে রব! তুমিতো বড়ই দয়ালু ও মমতাময়ী।

رَبَّنَا أَتْمِمْ لَنَا نُورَنَا وَاغْفِرْ لَنَا إِنَّكَ عَلٰى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ
২৮। হে আমাদের রব! আমাদের জন্য তুমি আমাদের নূরকে পরিপূর্ণ করে দাও। তুমি আমাদেরকে ক্ষমা কর। তুমি তো সবকিছুর উপর সর্বশক্তিমান।

رَبِّ اغْفِرْ لِي وَلِوَالِدَيَّ وَلِمَنْ دَخَلَ بَيْتِيَ مُؤْمِناً وَلِلْمُؤْمِنِينَ وَالْمُؤْمِنَاتِ
২৯। হে আমার রব! আমাকে, আমার মাতা-পিতাকে, যারা মুমিন অবস্থায় আমার পরিবারের অন্তর্ভুক্ত রয়েছে তাদেরকে এবং সকল মুমিন পুরুষ-নারীকে তুমি ক্ষমা করে দাও।

رَبَّنَا إِنَّنَا سَمِعْنَا مُنَادِياً يُنَادِي لِلإِيْمَانِ أَنْ آمِنُوا بِرَبِّكُمْ فَآمَنَّا رَبَّنَا فَاغْفِرْ لَنَا ذُنُوبَنَا وَكَفِّرْ عَنَّا سَيِّئَاتِنَا وَتَوَفَّنَا مَعَ الأَبْرَارِ
৩০। হে আমার রব! নিশ্চয়ই আমরা এক আহ্বানকারীকে আহ্বান করতে শুনেছিলাম যে, তোমরা স্বীয় প্রতিপালকের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন কর, তাতেই আমরা বিশ্বাস স্থাপন করেছি, হে আমাদের প্রতিপালক! অতএব আমাদের অপরাধসমূহ ক্ষমা কর ও আমাদের পাপরাশি মোচন কর এবং পুণ্যবানদের সাথে আমাদেরকে মৃত্যু দান কর।

• হাদীসের নির্বাচিত দো‘আ:

মন খুলে, হৃদয় উজাড় করে আল্লাহ তা’আলার নিকট দোয়া করুন।
اللَّهُمَّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ مِنْ فِتْنَةِ النَّارِ وَعَذَابِ النَّارِ وَفِتْنَةِ الْقَبْرِ وَعَذَابِ الْقَبْرِ وَشَرِّ فِتْنَةِ الْغِنَى وَشَرِّ فِتْنَةِ الْفَقْرِ – اللَّهُمَّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ مِنْ شَرِّ فِتْنَةِ الْمَسِيحِ الدَّجَّالِ – اللَّهُمَّ اغْسِلْ قَلْبِي بِمَاءِ الثَّلْجِ وَالْبَرَدِ وَنَقِّ قَلْبِي مِنَ الْخَطَايَا كَمَا نَقَّيْتَ الثَّوْبَ الْأَبْيَضَ مِنْ الدَّنَسِ وَبَاعِدْ بَيْنِي وَبَيْنَ خَطَايَايَ كَمَا بَاعَدْتَ بَيْنَ الْمَشْرِقِ وَالْمَغْرِبِ – اللَّهُمَّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ مِنَ الْكَسَلِ وَالْمَأْثَمِ وَالْمَغْرَمِ
৩১। হে আল্লাহ! আমি আপনার নিকট আশ্রয় চাচ্ছি, জাহান্নামের ফিতনা ও জাহান্নামের শাস্তি থেকে। কবরের ফিতনা ও কবরের ‘আযাব থেকে। আশ্রয় চাচ্ছি, সম্পদের ফিতনা ও দারিদ্রের ফিতনার ক্ষতি থেকে।
হে আল্লাহ! আমি তোমার নিকট আশ্রয় চাচ্ছি মাসীহিদ দাজ্জালের অনিষ্ট থেকে।
হে আল্লাহ! আমার অন্তরকে বরফ ও ঠাণ্ডা পানি দিয়ে ধৌত করে দাও। আমার অন্তরকে গুনাহ থেকে পরিষ্কার করে দাও। যেমন সাদা কাপড়কে ময়লা থেকে তুমি পরিষ্কার করে থাকো। হে আল্লাহ! থেকে পূর্ব থেকে পশ্চিম দিগন্ত পর্যন্ত তুমি যে বিশাল দূরত্ব সৃষ্টি করেছ আমার আমলনামা থেকে আমার গুনাহগুলো ততটুকু দূরে সরিয়ে দাও। হে আল্লাহ! আমার অলসতা, গুনাহ ও ঋণ থেকে আমি তোমার নিকট আশ্রয় চাই।

اللَّهُمَّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ مِنْ الْعَجْزِ وَالْكَسَلِ وَالْجُبْنِ وَالْهَرَمِ وَالْبُخْلِ وَأَعُوذُ بِكَ مِنْ عَذَابِ الْقَبْرِ وَمِنْ فِتْنَةِ الْمَحْيَا وَالْمَمَامِ
৩২। হে আল্লাহ! আমি তোমার নিকট আশ্রয় চাই অক্ষমতা, অলসতা, কাপুরুষতা, বার্ধক্য, কৃপণতা থেকে। আশ্রয় চাই তোমার নিকট কবরের আযাব ও জীবন মরনের ফিতনা থেকে।

اللَّهُمَّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ مِنْ جَهْدِ الْبَلاَءِ وَدَرَكِ الشَّقَاءِ وَسُوءِ الْقَضَاءِ وَشَمَاتَةِ الأَعْدَاءِ
৩৩। হে আল্লাহ! আমি তোমার নিকট আশ্রয় চাই, কঠিন বালা-মুসিবত, দুর্ভাগ্য ও শত্রুদের বিদ্বেষ থেকে।

– اللَّهُمَّ أَصْلِحْ لِي دِينِي الَّذِي هُوَ عِصْمَةُ أَمْرِي – وَأَصْلِحْ لِي دُنْيَايَ الَّتِي فِيهَا مَعَاشِي – وَأَصْلِحْ لِي آخِرَتِي الَّتِي فِيهَا مَعَادِي – وَاجْعَلِ الْحَيَاةَ زِيَادَةً لِي فِي كُلِّ خَيْرٍ – وَاجْعَلِ الْمَوْتَ رَاحَةً لِي مِنْ كُلِّ شَرٍّ
৩৪। হে আল্লাহ! আমার দ্বীনকে আমার জন্য সঠিক করে দিও যা কর্মের বন্ধন। দুনিয়াকেও আমার জন্য সঠিক করে দাও যেখানে রয়েছে আমার জীবন যাপন। আমার জন্য আমার পরকালকে পরিশুদ্ধ করে দাও, যা হচ্ছে আমার অনন্তকালের গন্তব্যস্থল। প্রতিটি ভাল কাজে আমার জীবনকে বেশী বেশী কাজে লাগাও এবং সকল অমঙ্গল ও কষ্ট থেকে আমার মৃত্যুকে আরামদায়ক করে দিও।

اللَّهُمَّ إِنِّي أَسْأَلُكَ الْهُد্ى وَالتُّقٰى وَالْعَفَافَ وَالْغِنٰى
৩৫। হে আল্লাহ! আমি তোমার নিকট হেদায়াত তাকওয়া ও পবিত্র জীবন চাই। আরো চাই যেন কারো কাছে দ্বারস্থ না হই।

اَللَّهُمَّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ مِنْ الْعَجْزِ وَالْكَسَلِ وَالْجُبْنِ وَالْبُخْلِ وَالْهَرَمِ وَعَذَابِ الْقَبْرِ- اَللَّهُمَّ آتِ نَفْسِي تَقْوَاهَا وَزَكِّهَا أَنْتَ خَيْرُ مَنْ زَكَّاهَا أَنْتَ وَلِيُّهَا وَمَوْلاَهَا – اللَّهُمَّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ مِنْ عِلْمٍ لاَ يَنْفَعُ وَمِنْ قَلْبٍ لاَ يَخْشَعُ وَمِنْ نَفْسٍ لاَ تَشْبَعُ وَمِنْ دَعْوَةٍ لاَ يُسْتَجَابُ لَهَا
৩৬। হে আল্লাহ! আমি তোমার নিকট আশ্রয় চাচ্ছি, অক্ষমতা, অলসতা, কাপুরুষতা, কৃপণতা, বার্ধক্য ও কবরের ‘আযাব থেকে।
হে আল্লাহ! তুমি আমার মনে তাকওয়ার অনুভূতি দাও, আমার মনকে পবিত্র কর, তুমি-ই তো আত্মার পবিত্রতা দানকারী। তুমিই তো হৃদয়ের মালিক, অভিভাবক ও বন্ধু।
হে আল্লাহ! আমি তোমার নিকট আশ্রয় চাই এমন ‘ইল্‌ম থেকে যে ‘ইল্‌ম কোন উপকার দেয় না, এমন হৃদয় থেকে যে হৃদয় বিনম্র হয় না, এমন আত্মা থেকে যে আত্মা পরিতৃপ্ত হয় না এবং এমন দোয়া থেকে তোমার নিকট আশ্রয় চাই যে দোয়া কবূল হয় না।

اللَّهُمَّ اهْدِنِيْ وَسَدِّدْنِي – اللَّهُمَّ إِنِّي أَسْأَلُكَ الْهُد্ى وَالسَّدَادَ
৩৭। হে আল্লাহ! আমাকে হেদায়াত দান কর, আমাকে সঠিক পথে পরিচালিত কর। হে আল্লাহ! তোমার নিকট হেদায়াত ও সঠিক পথ কামনা করছি।

اللَّهُمَّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ مِنْ زَوَالِ نِعْمَتِكَ وَتَحَوُّلِ عَافِيَتِكَ وَفُجَاءَةِ نِقْمَتِكَ وَجَمِيعِ سَخَطِكَ
৩৮। হে আল্লাহ! তোমার দেয়া নেয়ামাত চলে যাওয়া ও অসুস্থতার পরিবর্তন হওয়া থেকে আশ্রয় চাই, আশ্রয় চাই তোমার পক্ষ থেকে আকষ্মিক গজব আসা ও তোমার সকল অসন্তোষ থেকে।

اللَّهُمَّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ مِنْ شَرِّ مَا عَمِلْتُ وَمِنْ شَرِّ مَا لَمْ أَعْمَلْ
৩৯। হে আল্লাহ! আমি আমার অতীতের কৃতকর্মের অনিষ্টতা থেকে তোমার কাছে আশ্রয় চাই এবং যে কাজ আমি করিনি তার অনিষ্টতা থেকেও আশ্রয় চাই।।

اَللَّهُمَّ إِِنِّيْ أِعُوْذُبِكَ أِنْ أُشْرِكَ بِكَ وَأَنَا أِعْلَمُ وَأَسْتَغْفِرُكَ لِمَا لاَ أَعْلَمُ
৪০। হে আল্লাহ! আমার জানা অবস্থায় তোমার সাথে শিরক করা থেকে তোমার নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করছি। আর যদি অজান্তে শিক হয়ে থাকে তবে ক্ষমা প্রার্থনা করছি।

اللَّهُمَّ رَحْمَتَكَ أَرْجُو – فَلاَ تَكِلْنِيْ إِلٰى نَفْسِيْ طَرْفَةَ عَيْنٍ – وَأَصْلِحْ لِيْ شَأْنِيْ كُلَّه – لاَ إِلٰهَ إِلاَّ أَنْتَ
৪১। হে আল্লাহ! তোমার রহমত প্রত্যাশা করছি। সুতরাং তুমি আমার নিজের উপর তাৎক্ষণিকভাবে কোন দায়িত্ব অর্পণ করে দিও না। আর আমার সব কিছু তুমি সহীহ শুদ্ধ করে দাও। তুমি ছাড়া আর কোন মা’বুদ নেই।

অভিশাপ

কাজী নজরুল ইসলাম

যেদিন আমি হারিয়ে যাব, বুঝবে সেদিন বুঝবে,
অস্তপারের সন্ধ্যাতারায় আমার খবর পুছবে –
বুঝবে সেদিন বুঝবে!
ছবি আমার বুকে বেঁধে
পাগল হয়ে কেঁদে কেঁদে
ফিরবে মরু কানন গিরি,
সাগর আকাশ বাতাস চিরি’
যেদিন আমায় খুঁজবে –
বুঝবে সেদিন বুঝবে!
স্বপন ভেঙ্গে নিশুত রাতে, জাগবে হঠাৎ চমকে
কাহার যেন চেনা ছোয়ায় উঠবে ও-বুক ছমকে-
জাগবে হঠাৎ ছমকে,
ভাববে বুঝি আমিই এসে
বসনু বুকের কোলটি ঘেষে
ধরতে গিয়ে দেখবে যখন
শুন্য শয্যা মিথ্যা স্বপন
বেদনাতে চোখ বুজবে-
বুঝবে সেদিন বুঝবে!
গাইতে ব’সে কন্ঠ ছিড়ে আসবে যখন কান্না,
ব’লবে সবাই – “সেই যে পথিক, তার শেখানো গান না?”
আসবে ভেঙে কান্না!
প’ড়বে মনে আমার সোহাগ,
কন্ঠে তোমার কাঁদবে বেহাগ!
প’ড়বে মনে অনেক ফাঁকি
অশ্রু-হারা কঠিন আঁখি
ঘন ঘন মুছবে –
বুঝবে সেদিন বুঝবে!
আবার যেদিন শিউলি ফুটে ভ’রবে তোমার অঙ্গন,
তুলতে সে-ফুল গাঁথতে মালা কাঁপবে তোমার কঙ্কণ –
কাঁদবে কুটীর-অঙ্গন!
শিউলি ঢাকা মোর সমাধি
প’ড়বে মনে, উঠবে কাঁদি’!
বুকের মালা ক’রবে জ্বালা
চোখের জলে সেদিন বালা
মুখের হাসি ঘুচবে –
বুঝবে সেদিন বুঝবে!
আসবে আবার আশিন-হাওয়া, শিশির-ছেঁচা রাত্রি,
থাকবে সবাই – থাকবে না এই মরণ-পথের যাত্রী!
আসবে শিশির-রাত্রি!
থাকবে পাশে বন্ধু স্বজন,
থাকবে রাতে বাহুর বাঁধন,
বঁধুর বুকের পরশনে
আমার পরশ আনবে মনে-
বিষিয়ে ও-বুক উঠবে-
বুঝবে সেদিন বুঝবে!
আসবে আবার শীতের রাতি, আসবে না’ক আর সে-
তোমার সুখে প’ড়ত বাধা থাকলে যে-জন পার্শ্বে,
আসবে না’ক আর সে!
প’ড়বে মনে, মোর বাহুতে
মাথা থুয়ে যে-দিন শুতে,
মুখ ফিরিয়ে থাকতে ঘৃণায়!
সেই স্মৃতি তো ঐ বিছানায়
কাঁটা হ’য়ে ফুটবে-
বুঝবে সেদিন বুঝবে!
আবার গাঙে আসবে জোয়ার, দুলবে তরী রঙ্গে,
সেই তরীতে হয়ত কেহ থাকবে তোমার সঙ্গে-
দুলবে তরী রঙ্গে,
প’ড়বে মনে সে কোন্ রাতে
এক তরীতে ছিলেম সাথে,
এমনি গাঙ ছিল জোয়ার,
নদীর দু’ধার এমনি আঁধার
তেমনি তরী ছুটবে-
বুঝবে সেদিন বুঝবে!
তোমার সখার আসবে যেদিন এমনি কারা-বন্ধ,
আমার মতন কেঁদে কেঁদে হয়ত হবে অন্ধ-
সখার কারা-বন্ধ!
বন্ধু তোমার হানবে হেলা
ভাঙবে তোমার সুখের মেলা;
দীর্ঘ বেলা কাটবে না আর,
বইতে প্রাণের শান- এ ভার
মরণ-সনে বুঝবে-
বুঝবে সেদিন বুঝবে!
ফুটবে আবার দোলন চাঁপা চৈতী-রাতের চাঁদনী,
আকাশ-ছাওয়া তারায় তারায় বাজবে আমার কাঁদনী-
চৈতী-রাতের চাঁদনী।
ঋতুর পরে ফিরবে ঋতু,
সেদিন-হে মোর সোহাগ-ভীতু!
চাইবে কেঁদে নীল নভো গা’য়,
আমার মতন চোখ ভ’রে চায়
যে-তারা তা’য় খুঁজবে-
বুঝবে সেদিন বুঝবে!
আসবে ঝড়, নাচবে তুফান, টুটবে সকল বন্ধন,
কাঁপবে কুটীর সেদিন ত্রাসে, জাগবে বুকে ক্রন্দন-
টুটবে যবে বন্ধন!
পড়বে মনে, নেই সে সাথে
বাঁধবে বুকে দুঃখ-রাতে-
আপনি গালে যাচবে চুমা,
চাইবে আদর, মাগবে ছোঁওয়া,
আপনি যেচে চুমবে-
বুঝবে সেদিন বুঝবে।
আমার বুকের যে কাঁটা-ঘা তোমায় ব্যথা হানত্
সেই আঘাতই যাচবে আবার হয়ত হ’য়ে শ্রান–
আসবে তখন পান’।
হয়ত তখন আমার কোলে
সোহাগ-লোভে প’ড়বে ঢ’লে,
আপনি সেদিন সেধে কেঁদে
চাপবে বুকে বাহু বেঁধে,
চরণ চুমে পূজবে-
বুঝবে সেদিন বুঝবে!

By মুহাম্মাদ শহিদুল ইসলাম Posted in কবিতা

নামাযের ফযীলত

০১ ছালাত সর্বোত্তম আমল: রাসূলুল্লাহ্‌ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)কে প্রশ্ন করা হল কোন আমলটি সর্বোত্তম? তিনি বললেন, সময়মত ছালাত আদায় করা। (মুসলিম)

০২ ছালাত বান্দা এবং প্রভুর মাঝে সম্পর্কের মাধ্যম: রাসূলুল্লাহ্‌ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, তোমাদের কেউ যখন ছালাত আদায় করে, তখন সে তার পালনকর্তার সাথে গোপনে কথা বলে। (বুখারী)

০৩ ছালাত দ্বীনের মূল খুঁটি: রাসূলুল্লাহ্‌ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, সবকিছুর মূল হচ্ছে ইসলাম। তার (ইসলামের) মূল স্তম্ভ হচ্ছে ছালাত এবং তার (ইসলামের) সর্বোচ্চ চুড়া হচ্ছে জিহাদ। (তিরমিযী)

০৪ ছালাত হচ্ছে আলোকবর্তিকা: রাসূলুল্লাহ্‌ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, ছালাত হচ্ছে (কিয়ামতের দিন বান্দার জন্য) নূর বা আলোকবর্তিকা। (মুসলিম, তিরমিযী)

০৫ মুনাফেকী থেকে মুক্তি লাভের মাধ্যম হচ্ছে ছালাতঃ রাসূলুল্লাহ্‌ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, মুনাফেকদের উপর ফজর ও এশা ছালাতের চাইতে অধিক ভারী কোন ছালাত নেই। তারা যদি জানত এ দু‘ছালাতে কত ছওয়াব রয়েছে, তবে হামাগুড়ি দিয়ে হলেও তাতে উপস্থিত হত। (বুখারী ও মুসলিম)

০৬ ছালাত জাহান্নাম থেকে নিরাপত্তার গ্যারান্টি: রাসূলুল্লাহ্‌ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, কখনই জাহান্নামে প্রবেশ করবে না এমন ব্যক্তি, যে সূর্যোদয়ের পূর্বে ছালাত আদায় করেছে এবং সূর্যাস্তের-র পূর্বে ছালাত আদায় করেছে। অর্থাৎ- ফজর ও আছর ছালাত। (মুসলিম)

০৭ নিশ্চয় ছালাত মানুষকে অশ্লীল ও গর্হিত কাজ থেকে বিরত রাখে: আল্লাহ্‌ তা‘আলা বলেন, اتْلُ مَا أُوحِيَ إِلَيْكَ مِنْ الْكِتَابِ وَأَقِمْ الصَّلَاةَ إِنَّ الصَّلَاةَ تَنْهَى عَنْ الْفَحْشَاءِ وَالْمُنْكَرِকুরআনের যা আপনার কাছে ওহী করা হয়েছে তা পাঠ করুন এবং ছালাত প্রতিষ্ঠা করুন। নিশ্চয় ছালাত অশ্লীল ও গর্হিত বিষয় থেকে বিরত রাখে। (সূরা আনকাবূত- ৪৫)

০৮ সকল কাজে সাহায্য লাভের মাধ্যম ছালাত: আল্লাহ্‌ বলেন, وَاسْتَعِينُوا بِالصَّبْرِ وَالصَّلَاةِ তোমরা ছবর (ধৈর্য) এবং ছালাতের মাধ্যমে (আল্লাহ্‌র কাছে) সাহায্য প্রার্থনা কর। (সূরা বাক্বারা- ৪৫)

০৯ একাকী ছালাত আদায় করার চেয়ে জামাতে আদায় করা অনেক উত্তম: রাসূলুল্লাহ্‌ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, একাকী ছালাত আদায় করার চেয়ে জামাতের সাথে ছালাত আদায় করা পঁচিশ গুণ বেশী মর্যাদা সম্পন্ন। (বুখারী ও মুসলিম)

১০ ফেরেশতারা মুছল্লীর জন্য মাগফেরাত ও রহমতের দুয়া করেন: রাসূলুল্লাহ্‌ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, তোমাদের কোন ব্যক্তি ছালাত আদায় করার পর যতক্ষণ স্বীয় জায়নামাজে বসে থাকে ততক্ষণ ওযু ভঙ্গ না হওয়া পর্যন্ত ফেরেশতারা তার জন্য দু‘আ করতে থাকে। বলে, হে আল্লাহ্‌ তাকে ক্ষমা কর, তাকে রহম কর। (বুখারী ও মুসলিম)

১১ ছালাত গুনাহ্‌ মাফের মাধ্যম: রাসূলুল্লাহ্‌ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, যে ব্যক্তি ছালাতের জন্য ওযু করবে এবং ওযুকে পরি পূর্ণরূপে করবে। তারপর ফরয ছালাত আদায় করার জন্য পথ চলবে; অতঃপর তা মানুষের সাথে বা জামাতে বা মসজিদে আদায় করবে, তাহলে আল্লাহ্‌ তার গুনাহ্‌ সমূহ ক্ষমা করে দিবেন। (মুসলিম)
ছালাতের মাধ্যমে শরীর থেকে গুনাহ‌গুলো বের হয়ে যায়: রাসূলুল্লাহ্‌ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, তোমরা কি মনে কর, তোমাদের কারো ঘরের সামনে যদি একটি নদী প্রবাহিত থাকে। এবং প্রতিদিন সে উহাতে পাঁচ বার গোসল করে, তবে তার শরীরে কোন ময়লা থাকবে কি? তাঁরা (সাহাবিগণ) বললেন: কোন ময়লাই বাকী থাকতে পারে না। তিনি বললেন: এরূপ উদাহরণ হল পাঁচ ওয়াক্ত ছালাতের ক্ষেত্রেও। এভাবে ছালাতের বিনিময়ে আল্লাহ্‌ নামাযীর যাবতীয় (ছোট) পাপগুলো মোচন করে দেন। (বুখারী ও মুসলিম)
ছালাতের জন্য মসজিদে গমন করলে এক পদে গুনাহ মোচন হয় অন্য পদে মর্যাদা উন্নীত হয়: রাসূলুল্লাহ্‌ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, যে ব্যক্তি নিজ গৃহে ওযুর মাধ্যমে পবিত্রতা অর্জন করে, তারপর আল্লাহ্‌র কোন এক ঘরে (মসজিদে) যায় আল্লাহ্‌র কোন একটি ফরজ ছালাত আদায় করার জন্য, তবে তার পদক্ষেপগুলোর বিনিময়ে একটি পদে একটি গুনাহ মোচন করা হয় অন্য পদে একটি মর্যাদা উন্নীত হয়। (মুসলিম)
১২ আগেভাগে ছালাতে আসার মর্যাদা: রাসূলুল্লাহ্‌ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, মানুষ যদি জানত আজান দেয়া এবং প্রথম কাতারে ছালাত আদায় করার প্রতিদান কি, তাহলে (কে আজান দেবে বা কে প্রথম কাতারে ছালাত আদায় করবে তা নির্ধারণ করার জন্য) তারা পরস্পর লটারি করতে বাধ্য হত। তারা যদি জানত আগেভাগে ছালাতে আসাতে কি প্রতিদান রয়েছে তবে, তারা প্রতিযোগিতায় নেমে পড়ত। (বুখারী ও মুসলিম)

১৩ ছালাতের জন্য অপেক্ষাকারী ছালাতরতই থাকে: রাসূলুল্লাহ্‌ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, তোমাদের কোন ব্যক্তি ছালারতই থাকে যতক্ষণ ছালাত তাকে বাধা দিয়ে রাখে। শুধু ছালাতই তাকে নিজ গৃহে বা পরিবারের কাছে ফিরে যাওয়া থেকে বিরত রাখে। (বুখারী ও মুসলিম)

১৪ ছালাতে আমীন বলার দ্বারা পূর্বের গুনাহ্‌ ক্ষমা হয়ে যায়: রাসূলুল্লাহ্‌ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, তোমাদের কোন ব্যক্তি যখন (সূরা ফাতিহা শেষে) ‘আমীন’ বলে। আর ফেরেশতারা আসমানে বলে ‘আমীন’। তাদের একজনের আমীন বলা অন্য জনের সাথে মিলে গেলে তার পূর্বের গুনাহ্‌ ক্ষমা হয়ে যায়। (বুখারী ও মুসলিম)

১৫ ছালাতের মাধ্যমে আল্লাহ্‌র নিরাপত্তা লাভ করা যায়: রাসূলুল্লাহ্‌ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, যে ব্যক্তি সকালের (ফজর) ছালাত আদায় করে সে আল্লাহ্‌র জিম্মাদারিতে হয়ে যায়। ভেবে দেখ হে আদম সন্তান! আল্লাহ্‌ যেন তার জিম্মাদারিতে তোমার কাছে কোন কিছু চেয়ে না বসেন। (মুসলিম)

১৬ ছালাতের দ্বারা কিয়ামত দিবসে পরিপূর্ণ নূর লাভ করা যায়: রাসূলুল্লাহ্‌ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, যারা অন্ধকারে (অর্থাৎ- ফজরের ছালাত আদায় করার জন্য) মসজিদে গমন করে, তাদেরকে কিয়ামত দিবসে পরিপূর্ণ নূরের সুসংবাদ দিয়ে দাও। (আবূ দাঊদ, তিরমিযী)

১৭ আছর ও ফজরের ছালাত আদায়কারীর জন্য জান্নাতের সুসংবাদ: রাসূলুল্লাহ্‌ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, যে ব্যক্তি দুঠান্ডার সময়ের (আছর ও ফজর) ছালাত আদায় করবে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। (বুখারী ও মুসলিম)

১৮ পুলসিরাত পার হয়ে জান্নাতে যাওয়ার সুসংবাদ: রাসূলুল্লাহ্‌ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, প্রত্যেক পরহেজগার ব্যক্তির গৃহ হচ্ছে মসজিদ। আর যে ব্যক্তির গৃহ হবে মসজিদ আল্লাহ্‌ তার জন্য করুণা ও দয়ার জিম্মাদার হয়ে যান এবং আরও জিম্মাদারি নেন পুলসিরাত পার হয়ে আল্লাহ্‌র সন’ষ্টি জান্নাতে যাওয়ার। (ত্ববরানী, শায়খ আলবানী হাদছীটিকে ছহীহ বলেছেন।)

১৯ ছালাত শয়তান থেকে নিরাপদ থাকার মাধ্যম: রাসূলুল্লাহ্‌ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, কোন গ্রামে যদি তিনজন লোক থাকে এবং তারা জামাতের সাথে ছালাত প্রতিষ্ঠা না করে তবে শয়তান তাদের উপর প্রাধান্য বিস্তার করে। সুতরাং তোমরা জামাত বদ্ধ থাক। কেননা দুল ছুট একক ছাগলকে নেকড়ে বাঘ খেয়ে ফেলে। (আহমাদ, আবু দাউদ, নাসাঈ, দ্র: ছহীহুল জামে হা/ ৫৭০১)

২০ ছালাত আদায়কারীর জন্য ফেরেশতারা সাক্ষ্য দান ককরে:রাসূলুল্লাহ্‌ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, রাতে একদল ফেরেশতা এবং দিনে একদল ফেরেশতা তোমাদের নিকট আআগমনকরে। তারা ফজর ছালাত এবং আছর ছালাতে পরস্পর মিলিত হয়। তারপর যেসকল ফেরেশতা রাতে তোমাদের নিকট আআগমনকরেছিল তারা চলে যায়, তখন আল্লাহ্‌ তাদেরকে জিজ্ঞেস করেন- অথচ তিনি সর্বাধিক জানেন- আমার বান্দাদেরকে কি অবস্থায় ছেড়ে এসেছ? তারা বলে, তাদেরকে রেখে এসেছি এমন অবস্থায় যে তারা ছালাত আদায় করছে এবং তাদেরকে এমন অবস্থায় আমরা পেয়েছি যে তারা ছালাত আদায় করছে। অন্য বর্ণনায় আছে, আমরা যখন তাদের কাছে যাই তখন তারা ছালাতরত ছিল এবং যখন তাদেরকে ছেড়ে আসি তখনও তারা ছালাতরত ছিল। সুতরাং তাদেরকে হিসাবের দিন ক্ষমা করুন। (বুখারী ও মুসলিম, দ্র: ছহীহ্‌ তারগীব ও তারহীব হা/৪৬৩)

২১ পূর্ণ রাত নফল ছালাত আদায় করার ছওয়াব: রাসূলুল্লাহ্‌ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, যে ব্যক্তি এশা ছালাত জামাতের সাথে আদায় করবে, সে যেন অর্ধ রাত্রি নফল ছালাত আদায় করল, এবং যে ব্যক্তি ফজর ছালাত জামাতের সাথে আদায় করবে, সে যেন পূর্ণ রাত্রি নফল ছালাত আদায় করল। (মুসলিম)

২২ ছালাতই কিয়ামত দিবসে আরশের নীচে ছায়া লাভের মাধ্যম: রাসূলুল্লাহ্‌ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, কিয়ামত দিবসে সাত ধরণের ব্যক্তিকে আরশের নীচে ছায়া দান করা হবে যে দিন আল্লাহ্‌র আরশের ছায়া ব্যতীত কোন ছায়া থাকবে না- তাদের মধ্যে একজন হচ্ছে এমন ব্যক্তি যার হৃদয় লটকানো থাকে মসজিদে। অর্থাৎ যখনই ছালাতের সময় হয় সে ছুটে যায় মসজিদের পানে। (বুখারী ও মুসলিম)

২৩ মুনাফেকী এবং জাহান্নাম থেকে মুক্তি লাভ: রাসূলুল্লাহ্‌ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, যে ব্যক্তি আল্লাহ্‌র জন্য চল্লিশ দিন (২০০ ওয়াক্ত) জামাতের সাথে ইমামের তাকবীরে তাহরীমার সাথে ছালাত আদায় করবে তার জন্য দু‘টি মুক্তি নামা লিখা হবে। ১) জাহান্নাম থেকে মুক্তি এবং ২) মুনাফেক্বী থেকে মুক্তি। (তিরমিযী, দ্র: ছহীহুল জামে হা/৬৩৬৫)

মুসলমানদের ১৫ টি প্রশংসনীয় চারিত্রিক গুণাবলী

ইসলামী চরিত্রের মৌলিক বিষয়সমূহ

১ সত্যবাদিতা:

আল্লাহ তাআলা এবং তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের যে সকল ইসলামী চরিত্রের নির্দেশ দিয়েছেন, তার অন্যতম হচ্ছে সত্যবাদিতার চরিত্র। আল্লাহ তাআলা বলেন,

“হে ঈমানদারগণ আল্লাহকে ভয় কর এবং তোমরা সত্যবাদীদের সাথী হও।” সূরা আত-তাওবাহ : ১১৯

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেছেন,

“তোমরা সততা অবলম্বন গ্রহণ কর, কেননা সত্যবাদিতা পুণ্যের পথ দেখায় আর পূণ্য জান্নাতের পথ দেখায়, একজন লোক সর্বদা সত্য বলতে থাকে এবং সত্যবাদিতার প্রতি অনুরাগী হয়, ফলে আল্লাহর নিকট সে সত্যবাদী হিসাবে লিপিবদ্ধ হয়ে যায়।” মুসলিম

২ আমানতদারিতা :

মুসলমানদের সে সব ইসলামী চরিত্র অবলম্বনের নির্দেশ দেয়া হয়েছে তার একটি হচ্ছে আমানতসমূহ তার অধিকারীদের নিকট আদায় করে দেয়া। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ

“নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের নির্দেশ দিচ্ছেন আমানতসমূহ তার হকদারদের নিকট আদায় করে দিতে।” সূরা আন নিসা : ৫৮

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর সম্প্রদায়ের নিকট আল আমীন উপাধি লাভ করেছিলেন, তারা তাঁর নিকট তাদের সম্পদ আমানত রাখত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং তার অনুসারীদের মুশরিকরা কঠোর ভাবে নির্যাতন শুরু করার পর যখন আল্লাহ তাকে মক্কা হতে মদীনা হিজরত করার অনুমতি দিলেন তিনি আমানতের মালসমূহ তার অধিকারীদের নিকট ফিরিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা না করে হিজরত করেননি। অথচ যারা আমানত রেখেছিল তারা সকলেই ছিল কাফের। কিন্তু ইসলাম তো আমানত তার অধিকারীদের নিকট ফিরিয়ে দিতে নির্দেশ দিয়েছে যদিও তার অধিকারীরা কাফের হয়।

৩ অঙ্গীকার পূর্ণ করা:

ইসলামী মহান চরিত্রের অন্যতম হচ্ছে অঙ্গীকার পূর্ণ করা। আল্লাহ তাআলা বলেন :

“আর অঙ্গীকার পূর্ণ কর, কেননা অঙ্গীকার সম্বন্ধে জিজ্ঞাসিত হবে।” সূরা ইসরা : ৩৪
আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রতিশ্রতি ভঙ্গকরা মুনাফিকের বৈশিষ্ট্যের মধ্যে গণ্য করেছেন।

৪ বিনয় :

ইসলামী চরিত্রের আরেকটি হচ্ছে একজন মুসলমান তার অপর মুসলিম ভাইদের সাথে বিনয়ী আচরণ করবে। সে ধনী হোক বা গরীব। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ

“তুমি তোমার পার্শ্বদেশ মুমিনদের জন্য অবনত করে দাও।” সূরা আল হিজর : ৮৮

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেছেন,

“আল্লাহ তাআলা আমার নিকট ওহী করেছেন যে, ‘তোমরা বিনয়ী হও যাতে একজন অপরজনের উপর অহংকার না করে। একজন অপর জনের উপর সীমালংঘন না করে।” -মুসলিম।

৫ মাতা-পিতার প্রতি সদ্ব্যবহার:

মাতা-পিতার প্রতি সদ্ব্যবহার উত্তম চরিত্রের অন্যতম। আর এটা তাদের অধিকার মহান হওয়ার কারণে, যে অধিকার স্থান হল আল্লাহর হকের পরে।আল্লাহ তাআলা বলেনঃ

‘আর আল্লাহর ইবাদত কর, তাঁর সাথে কোন কিছুকে শরীক করো না, এবং মাতা-পিতার প্রতি সদ্ব্যবহার কর।” [সূরা আন-নিসা : ৩৫ আয়াত]

আল্লাহ তাআলা তাদের আনুগত্য, তাদের প্রতি দয়া ও বিনয় এবং তাদের জন্য দু’আ করতে নির্দেশ দিয়েছেন। আল্লাহ তাআলা বলেন :

“তাদের উভয়ের জন্য দয়ার সাথে বিনয়ের ডানা নত করে দাও এবং বল, হে আমার রব! তাদের প্রতি দয়া কর যেভাবে শৈশবে আমাকে তারা লালন-পালন করেছেন।” [ সূরা আল ইসরা : ২৪ ]
এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নিকট এসে জিজ্ঞেস করল,

‘হে আল্লাহর রাসূল! আমার উত্তম আচরণ পাওয়ার সবচেয়ে বেশী অধিকারী ব্যক্তি কে ? তিনি বললেন, ‘তোমার মা।’ অত:পর জিজ্ঞেস করল তারপর কে? তিনি উত্তর দিলেন, ‘তোমার মা।’ অতঃপর জিজ্ঞেস করল তার পর কে? তিনি উত্তর দিলেন, ‘তোমার মা।’ অতঃপর জিজ্ঞেস করল তার পর কে? উত্তর দিলেন, ‘তোমার পিতা।’ [বুখারী ও মুসলিম]

মাতা-পিতার প্রতি এ সদ্ব্যবহার ও দয়া অনুগ্রহ অতিরিক্ত বা পূর্ণতা দানকারী বিষয় নয় বরং তা হচ্ছে সকল মানুষের ঐক্যমতের ভিত্তিতে ফরযে আইন।

৬ আত্মীয়তার সর্ম্পক বজায় রাখা :

আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখা ইসলামী চরিত্রের অন্যতম। আর তারা হচ্ছে নিকটাত্মীয়গণ যেমন, চাচা, মামা, ফুফা, খালা, ভাই, বোন প্রমূখ।

আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখা ওয়াজিব, আর তা ছিন্ন করা জান্নাত হতে বঞ্চিত ও অভিশাপের কারণ। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ

“ যদি তোমরা ক্ষমতা পাও, তাহলে কি তোমরা পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করবে এবং আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করবে? তারা তো ঐ সব লোক যাদের প্রতি আল্লাহ অভিশাপ করেছেন। এতে তিনি তাদেরকে বধির করে দিয়েছেন এবং তাদের দৃষ্টি অন্ধ করে দিয়েছেন।” [সূরা মুহাম্মাদ : ২২-২৩]
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেছেন,

“আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্নকারী বেহেশ্তে প্রবেশ করবে না।” [বুখারী ও মুসলিম]

৭ প্রতিবেশীর প্রতি সুন্দরতম ব্যবহার:

প্রতিবেশীর প্রতি সুন্দরতম ব্যবহার হচ্ছে ইসলামী চরিত্রের অন্যতম। প্রতিবেশী হচ্ছে সে সব লোক যারা আপনার বাড়ীর আশে পাশে বসবাস করে। যে আপনার সবচেয়ে নিকটবর্তী সে সুন্দর ব্যবহার ও অনুগ্রহের সবচেয়ে বেশী হকদার। আল্লাহ তাআলা বলেন,

“আর মাতা-পিতার প্রতি সদ্ব্যবহার কর, নিকটাত্মীয়, এতিম, মিসকীন নিকটতম প্রতিবেশী ও দূরবর্তী প্রতিবেশীর প্রতিও।” [সূরা আন-নিসা : ৩৬]

এতে আল্লাহ নিকটতম ও দূরবর্তী প্রতিবেশীর প্রতি সদ্ব্যবহার করতে ওসিয়ত করেছেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেনঃ

‘জিবরীল আমাকে প্রতিবেশীর ব্যাপারে ওসিয়ত করতেছিল এমনকি আমি ধারণা করেনিলাম যে, প্রতিবেশীকে উত্তরাধিকার বানিয়ে দেয়া হবে।’ [বুখারী ও মুসলিম]

অর্থাৎ আমি মনে করেছিলাম যে ওয়ারিশদের সাথে প্রতিবেশীর জন্য মিরাসের একটি অংশ নির্ধারিত করে দেবে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আবু যর রা. কে লক্ষ্য করে বলেন,
‘হে আবু যর! যখন তুমি তরকারী পাক কর তখন পানি বেশি করে দাও, আর তোমার প্রতিবেশীদের অঙ্গীকার পূরণ কর।” [ মুসলিম]

প্রতিবেশীর পার্শ্বাবস্থানের হক রয়েছে যদিও সে আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের প্রতি অবিশ্বাসী বা কাফের হয়।

৮ মেহমানের আতিথেয়তা:

ইসলামী চরিত্রের আরেকটি হচ্ছে মেহমানের আতিথেয়তা। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর বাণী,

“যে ব্যক্তি আল্লাহ এবং পরকালের প্রতি বিশ্বাস করে সে যেন তার মেহমানকে সম্মান করে।” [বুখারী ও মুসলিম]

৯ সাধারণভাবে দান ও বদান্যতা:

ইসলামী চরিত্রের অন্যতম দিক হচ্ছে দান ও বদান্যতা। আল্লাহ তাআলা ইনসাফ, বদান্যতা ও দান কারীদের প্রশংসা করেছেন। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ

“যারা আল্লাহর রাস্তায় নিজেদের সম্পদ ব্যয় করে অতঃপর যা খরচ করেছে তা থেকে কারো প্রতি অনুগ্রহ ও কষ্ট দেয়ার উদ্দেশ্য করে না, তাদের জন্য তাদের প্রতিপালকের নিকট প্রতিদান রয়েছে। তাদের কোন ভয় নেই এবং তারা দুশ্চিন্তাও করবে না।” [সূরা আল বাকারাহ : ২৬২]

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেছেন,

‘যার নিকট অতিরিক্ত বাহন থাকে সে যেন যার বাহন নেই তাকে তা ব্যবহার করতে দেয়। যার নিকট অতিরিক্ত পাথেয় বা রসদ রয়েছে সে যেন যার রসদ নেই তাকে তা দিয়ে সাহায্য করে।” [মুসলিম]

১০ ধৈর্য্য ও সহিষ্ণুতা:

ধৈর্য্য ও সহিষ্ণুতা হচ্ছে ইসলামী চরিত্রের অন্যতম বিষয়। অনুরূপভাবে মানুষদের ক্ষমা করা, দুর্ব্যবহারকারীকে ছেড়ে দেয়া ওজর পেশকারীর ওজর গ্রহণ করা বা মেনে নেয়াও অন্যতম। আল্লাহ তাআলা বলেন :

“আর যে ধৈর্য্য ধারণ করল এবং ক্ষমা করল, নিশ্চয়ই এটা কাজের দৃঢ়তার অন্তর্ভূক্ত।” [সূরা আশ শুরা : ৪৩]

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন
‘তারা যেন ক্ষমা করে দেয় এবং উদারতা দেখায়, আল্লাহ তোমাদের ক্ষমা করে দেয়া কি তোমরা পছন্দ কর না?’ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “দান খয়রাতে সম্পদ কমে যায় না। আল্লাহ পাক ক্ষমার দ্বারা বান্দার মার্যাদাই বৃদ্ধি করে দেন। যে আল্লাহর জন্য বিনয় প্রকাশ করে আল্লাহ তার সম্মানই বৃদ্ধি করে দেন।” [মুসলিম ] তিনি আরো বলেন, “দয়া কর, তোমাদের প্রতি দয়া করা হবে। ক্ষমা করে দাও তোমাদেরও ক্ষমা করে দেয়া হবে।” [আহমাদ]

১১। মানুষের মাঝে সমঝোতা ও সংশোধন:

ইসলামী চরিত্রের আরেকটি হচ্ছে মানুষের মাঝে সমঝোতা ও সংশোধন করে দেয়া, এটা একটি মহান চরিত্র যা ভালবাসা সৌহার্দ প্রসার ও মানুষের পারষ্পারিক সহযোগিতার প্রাণের দিকে নিয়ে যায়।আল্লাহ তাআলা বলেন:

“তাদের অধিকাংশ শলাপরামর্শের মধ্যে কল্যাণ নেই। কেবল মাত্র সে ব্যক্তি ব্যতীত যে সাদকাহ, সৎকর্ম ও মানুষের মাঝে সংশোধনের ব্যাপারে নির্দেশ দেয়। যে আল্লাহর সন্তুষ্টির লক্ষ্যে এসব করে অচিরেই আমরা তাকে মহা প্রতিদান প্রদান করব।” [সূরা আন নিসা : ১১৪]

১২। লজ্জা:

ইসলামী চরিত্রের অন্যতম আরেকটি চরিত্র হচ্ছে লজ্জা। এটা এমন একটি চরিত্র যা পরিপূর্ণতা ও মর্যাদাপূর্ণ বৈশিষ্ট্যের দিকে আহবান করে। অশ্লীলতা ও বেহায়াপনা হতে বারণ করে। লজ্জা আল্লাহর পক্ষ হতে হয়ে থাকে। ফলে মুসলমান লজ্জা করে যে, আল্লাহ তাকে পাপাচারে লিপ্ত দেখবে। অনুরূপভাবে মানুষের থেকে এবং নিজের থেকেও সে লজ্জা করে। লজ্জা অন্তরে ঈমান থাকার প্রমাণ বহন করে। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেছেন,

‘লজ্জা ঈমানের বিশেষ অংশ।’ [বুখারী ও মুসলিম]

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরও বলেন, “লজ্জা কল্যাণ ছাড়া আর কিছুই নিয়ে আসে না।” [বুখারী ও মুসলিম]

১৩। দয়া ও করুণা:

ইসলামী চরিত্রের আরেকটি উল্লেখযোগ্য চরিত্র হচ্ছে দয়া বা করুণা। এ চরিত্রটি অনেক মানুষের অন্তর হতে ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে। ফলে তাদের অন্তর পাথরের মত অথবা এর চেয়েও শক্ত হয়ে গেছে। আর প্রকৃত মু’মিন হচ্ছে দয়াময়, পরোপকারী, গভীর অনুভূতি সম্পন্ন উজ্জল অনুগ্রহের অধিকারী। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ

“অত:পর সে তাদের অন্তর্ভূক্ত হয় যারা ঈমান এনেছে পরস্পর পরস্পরকে ধৈর্য্য ও করুণার উপদেশ দিয়েছে। তারা হচ্ছে দক্ষিণ পন্থার অনুসারী।” [সূরা আল-বালাদ : ১৭- ১৮]

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেছেন,

“মুমিনদের পারস্পরিক সৌহার্দ্য, করুণা, অনুকম্পার উপমা হচ্ছে একটি শরীরের মত। যখন তার একটি অঙ্গ অসুস্থ হয় গোটা শরীর নিদ্রাহীনতা ও জ্বরে আক্রান্ত হয়।” [মুসলিম]

১৪। ইনসাফ বা ন্যায়পরায়ণতা:

ন্যায় পরায়ণতা ইসলামী চরিত্রের আরেকটি অংশ। এ চরিত্র আত্মার প্রশান্তি সৃষ্টি করে। সমাজে নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠা এবং বিভিন্ন প্রকার অপরাধ বিমোচনের দিকে নিয়ে যায়। আল্লাহ তাআলা বলেন:

“নিশ্চয়ই আল্লাহ ন্যায়পরায়ণতা ইহসান ও নিকটাত্মীয়দের দান করতে নির্দেশ দেন।” [সূরা আল নাহাল : ৯০]

আল্লাহ তাআলা বলেন :

“ইনসাফ কর, এটা তাক্বওয়ার অতীব নিকটবর্তী।” [সূরা আল মায়িদা : ৮

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেছেন,

“ন্যায়পরায়ণ ব্যক্তিরা আল্লাহর নিকট নূরের মিম্বরের উপর বসবে। তারা হল সে সব লোক, যারা বিচার ফয়সালার ক্ষেত্রে, পরিবার-পরিজনের ক্ষেত্রে এবং যে দায়িত্বই পেয়েছে তাতে ইনসাফ করে।”

১৫। চারিত্রিক পবিত্রতা:

ইসলামী চরিত্রের অন্যতম বিষয় হচ্ছে চারিত্রিক পবিত্রতা। এ চরিত্র মানুষের সম্মান সংরক্ষণ এবং বংশে সংমিশ্রন না হওয়ার দিকে পৌঁছে দেয়। আল্লাহ তাআলা বলেন :

“যাদের বিবাহের সামর্থ নেই, তারা যেন চারিত্রিক পবিত্রতা গ্রহণ করে। যতক্ষণ না আল্লাহ তার অনুগ্রহে তাকে সম্পদশালী করেন।” [ সুরা আন নূর-৩৩ ]

রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এরশাদ করেছেন,

“তোমরা আমার জন্য ছয়টি বিষয়ের জিম্মাদার হও। তাহলে আমি তোমাদের জন্য জান্নাতের জিম্মাদার হব। যখন তোমাদের কেউ কথা বলে সে যেন মিথ্যা না বলে। যখন তার কাছে আমানত রাখা হয় তখন যেন খেয়ানত না করে। যখন প্রতিশ্র“তি দেয় তা যেন ভঙ্গ না করে। তোমরা তোমাদের দৃষ্টি অবনত কর। তোমাদের হস্তদ্বয় সংযত কর। তোমাদের লজ্জাস্থান হেজাফত কর।” [ হাদীসটি তাবারানী বর্ণনা করেছেন এবং হাদীসটিকে ‘হাসান’ বলেছেন

ইসলামের এ সব চরিত্রে এমন কিছু নেই যা ঘৃণা করা যায়। বরং এসব এমন সম্মান যোগ্য মহৎ চারিত্রাবলী যা প্রত্যেক নিষ্কলুষ স্বভাবের অধিকারীর সমর্থন লাভ করে। মুসলমানগণ যদি এ মহৎ চরিত্র ধারণ করত তাহলে সর্বস্থান থেকে তাদের নিকট মানুষ আগমন করত এবং দলে দলে আল্লাহর দ্বীনে তারা প্রবেশ করত যেভাবে প্রথম যুগের মুসলমানদের লেন-দেন ও চরিত্রের কারণে সে সময়ের মানুষ ইসলামে প্রবেশ করেছিল।

ইসলাম ও ন্যায়বিচার

এক)

ফাতিমা বিনতুল আসওয়াদ ধরা পড়লেন। ধরা পড়লেন চুরির দায়ে। মুসলিম সমাজ বজ্রাহতের মতো চমকে গেলো, থমকে গেল। চুরির শাস্তি তারা জানেন। নির্ঘাত হাত কাটা যাবে ফাতিমার। না, অভাবের তাড়নায় চুরি নয়। ক্ষুধা নিবারণে কেউ চুরি করলে তো আর ইসলাম হাত কাটে না, চুরি যেন না করতে হয় তার নিশ্চয়তায় পর্যাপ্ত সুযোগ সুবিধা আগেই নিশ্চিত করে ইসলাম ।
মাখজুমি বংশের মেয়ে ফাতিমা। সম্মান আর আভিজাত্যে আরব জোড়া সুনাম। আছে অর্থসম্পদ প্রাচুর্য। তবুও চুরির দায়ে ধরা পড়লেন ফাতিমা। কুরায়শদের মাঝে কানাকানি, ফিসফিসানি। কিছু একটা করা দরকার। বিব্রত কুরায়শগণ অবশেষে রাসূলের (সাঃ) কাছে শাস্তি কমানোর সুপারিশের কথা ভাবেন।
দয়ার নবী। কানায় কানায় করুনায় পূর্ণ হৃদয় । তবুও ন্যায়ের পথে হিমালয়ের চেয়ে অটল তিনি, জানেন সবাই। তার দয়ার দরিয়ায় সুপারিশের পাল তোলা নৌকা ভাসাবে এমন হিম্মত আছে বা কয় জনার।
উসামা ইবনে যায়েদ (রাঃ), নবীজির অতি প্রিয়। সবাই ঘিরে ধরেন তাকে। তিনিই পারবেন, সাহসের বৈঠা বেয়ে ঢেউ তুলবেন নবীজির দয়ার সাগরে। শরীরের সবটুকু সাহস বুকে তুলে দাড়ান তিনি নবীজির দরবারে। আবেদন করেন শাস্তি লাঘবের, সম্ভ্রান্ত বংশের রমণীর সম্মানহানি বাঁচাতে সুপারিশ করেন হাত না কাটার।
রাসূল (সাঃ) ব্যথিত হলেন। যার আগমন ধরায় সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠায়, তিনি হাত গুটিয়ে নেবেন ন্যায় বিচার থেকে? বিস্ময়ভরা কন্ঠে তিনি বললেন, “আল্লাহর অনুশাসন কার্যকরী করার ব্যাপারে তুমি সুপারিশের আশ্রয় গ্রহণ করছ?”
অতঃপর তিনি উঠে দাড়ালেন, জনতাকে সম্বোধন করে দৃঢ কন্ঠে ঘোষণা করলেন, “তোমাদের পূ্র্ববর্তী লোক শুধু এ জন্য ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে যে, তাদের মধ্যে কোন ভদ্র বা অভিজাত বংশীয় লোক চুরি করলে তারা তাকে ছেড়ে দিত। কিন্তু যদি কোন দূর্বল ব্যক্তি চুরি করত তবে তার উপর অনুশাসন কার্যকর করত। আল্লাহর শপথ, মুহাম্মাদ তনয়া ফাতিমাও যদি চুর করে তবে তার হাতও কর্তিত হবে”।
সেদিন থেকে বিশ্ববাসী শিক্ষা নিলেন, ন্যায়বিচারে আত্মীয়তার স্থান নেই, স্বজাতির স্থান নেই, অর্থ প্রতিপত্তির স্থান নেই।

দুই)

আলী (রাঃ)। আমিরুল মু’মিনীন আলী ইবনে আবু তালিব। যুদ্ধে অসীম বীরত্বে অধিকার করেছেন শেরে খোদা উপাধি। জেহাদের ময়দানে দূর্গম দূর্গের কপাট ভেঙ্গে ঢাল বানিয়ে যুদ্ধ জয় করতে পারেন যিনি অমন উপাধিতে তাকেই তো মানায়।
ঢাল নেই তলোয়ার নেই এমন নিধিরাম সরদাররদের জন্য যুদ্ধ নয়। যোদ্ধা মানেই সমরাস্ত্রে সজ্জিত দুঃসাহসী বীর। সেই বীরসেনা আলী (রাঃ) তার প্রিয় বর্ম হারালেন। নিজের বর্ম একদিন খুঁজেও পেলেন বাজারে। বাজারে কুফানিবাসী জনৈক খৃষ্টান বর্মটি বিক্রির জন্য হাকাহাকি করছেন। নিজের বর্ম, সহজে কি আর চিনতে ভুল হয়, তাও আবার বীর সেনানীর বর্ম। সহজেই চিনে ফেললেন তার হারানো বর্ম। তবু ছিনিয়েতো আর নেয়া যায় না। হ্যা তিনি মুসলিম জাহানের খলিফা, তাই বলে জোর করে, তথ্য প্রমাণ ছাড়াই নিজের বর্ম বলেতো আর কেড়ে নেয়া যায় না।
তিনি ছুটলেন কাজীর দরবারে। শুরা বিন হারিশের দরবারে নালিশ জানালেন কুফার খৃষ্টান ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে। খলিফাতুল মুসলেমিন হযরত আলী বিচার চাইলেন সাধারণ প্রজার মতো, যদিও কাজী তারই নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মচারীমাত্র।
ন্যায়ের প্রতীক কাজী। ভুলে গেলেন বিচারপ্রত্যাশীর পরিচয়। আমিরুল মুমেনিনের দাবীর স্বপক্ষে দু’জন স্বাক্ষী নিয়ে আসার আদেশ দিলেন। আলী (রাঃ) তার অভিযোগের স্বপক্ষে নিজের সন্তান হাসান (রাঃ) কে হাজির করলেন, হাজির করলেন তার দাসকেও।
তবুও মামলায় হেরে গেলেন ক্ষমতামীল আমিরুল মু’মেনিন হযরত আলী। পিতার পক্ষে সন্তানের, মালিকের পক্ষে দাসের স্বাক্ষী গৃহীত হলো না কাজীর দরবারে। শুরা বিন হারিশ রায় দিলেন খৃষ্টান ব্যবসায়ীর পক্ষে।
কুফাবাসী অভিভূত হলেন ন্যায় বিচারে। যে ইসলাম বিচারে বাছবিচার করে না ধনী আর গরীবে, আমির আর সাধারণ প্রজার মাঝে, যে ইসলাম বিচারে খৃষ্টানের বিপক্ষে পক্ষ নেয় না মুসলিম আমিরের, সে ইসলাম থেকে পালিয়ে থাকতে পারে কি বুদ্ধিমান কেউ? কাজীর নিরপেক্ষ বিচারে আলোকিত হয়ে ওঠে খৃষ্টান ব্যবসায়ীর হৃদয়। ছুটে আসেন ইসলামের সুশীতল ছায়ায়, ন্যায়ের ফল্গুধারায়।

তিন)

মৃত্যুদন্ড। রায় দিলেন কাজী সাহেব। রায় দিলেন রানী নূর জাহানের বিপক্ষে। ভারত উপমহাদেশের সম্রাট জাহাঙ্গীরের প্রাণপ্রিয় সহধর্মীনির মৃত্যুদন্ড ঘোষণা করলেন ন্যায়ের মূর্তপ্রতীক কাজী।
না, কোন প্রতিবাদ জানালেন না মহারাজ। কোন অভিযোগ নেই রানীমার অন্তরে। অভিযোগ করবেনই বা কেন? তিনি অপরাধ করেছেন, শাস্তি যে তাকে পেতেই হবে। তিনি খুন করেছেন। শিকারের পানে নিশানা করা তার তীর বিঁধেছে ধোপার বুকে। যদিও ইচ্ছে করে নয়, তবু খুনতো খুনই। অনিচ্ছাকৃত বলে তো আর বেঁচে উঠবে না ধোপা।
হ্যা, চাইলেই বিচারের রায় বাতিল করতে পারতেন সম্রাট। চাইলেই গর্দান নিতে পারতেন বিচারকের। তবু পারেন না তিনি। সকল বিচারকের বিচারক মহান আল্লাহ তালার ভয়ে কম্পিত সম্রাটের হৃদয়, কৃতঅপরাধে অনুতপ্ত রাণীর অন্তর। অবনত মন্তকে তিনি মেনে নিলেন কাজীর আদেশ।
কাজীর ন্যায় বিচারে হৃদয় আর্দ্র হয় ধোপার বিধবা বউয়ের। রাণী হয়েও যিনি প্রজার রক্তের বদলে রক্ত ঝরাতে মেনে নেন ফাঁসির আদেশ অমন রাণীর মৃত্যু কিছুতেই মেনে নিতে পারেন না তিনি। রাণীমার মৃত্যুতে তো আর ফিরবেনা তার স্বামী। কাজীর দরবারে আবেদন করেন মৃত্যুদন্ড প্রত্যাহারে। রক্তমূল্য পরিশোধে প্রাণ ফিরে পান সম্রাট জাহাঙ্গীরের বেগম মহারাণী নূর জাহান।
জয় হলো ন্যায় বিচারের, জয় হলো সুশাসনের।
ইসলামে সবাই সমান, এক আল্লাহর বান্দা। ধনী গরিব, আমির ফকির বিচারে বিবেচ্য নয়, ন্যায় বিচারই ইসলামের মর্মকথা। ইসলামের বাহারী গুলবাগের অন্যতম মনকাড়া সুবাসিত ফুলের নাম ন্যায়বিচার। অথচ আজ বিশ্বের সর্বত্র বিচারের বানী নিভৃতে কাঁদে। সাধারণ মানুষ আজ আর ইহলোকিক কোন রাষ্ট্রযন্ত্রের কাছে ন্যায় বিচারের মিছে আশা করে না, ন্যয় বিচারের জন্য তারা আল্লাহর দরবারে ফরিয়াদ করে করে কাঁদে।
আমাদের শাসকেরা আজ ইসলাম থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে ন্যায়বিচার শিখছি তাদের কাছ থেকে যারা মনে করতেন সমাজের উচুশ্রেণীর নাগরিকেরা আইনের উর্ধ্বে। সম্রাট জাহাঙ্গীরের সমসাময়িক ব্রিটিশ শাসক ১ম জেমস মনে করতেন তিনি আইন উর্ধ্বের প্রভূ, তার কথাই আইন , তার হুকুমই শেষ কথা। আমরা তাদের কাছে মানবতাবাদ শিখছি, যারা সেকেন্ডেই ধ্বংস করেছে হিরোশিমা নাগাসাকির মতো বড় বড় শহর, গণবিধ্বস্তী অস্ত্রের ধুয়ো তুলে যারা হাজার হাজার মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করে।
নিশ্চয় আল্লাহ সব কিছু জানেন এবং সব কিছুই শ্রবণ করেন। নিশ্চয়ই অবহেলিত সাধারণ মানুষের ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠায় কায়েম হবে ইসলামী হুকুমাত। আমরা সেদিনেরই অপেক্ষায়।

ইসলামই মুক্তির একমাত্র পথ

আলচনার উদ্দেশ্য (Objective):

* শাশ্বত ও সার্বজনীন জীবন ব্যবস্থা ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমান করা। পাশাপাশি বর্তমান ও অতীতের কয়েকটি ভ্রান্ত মতবাদের অসারতা প্রমান করা ।

* প্রধান প্রধান কয়েকটি জাহেলী মতবাদ সম্পর্কে ধারনা প্রধান করা এবং জাহেলিয়াতের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা যে ইসলাম প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই সম্ভব ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের মনে সে ধারনা অর্জনে সহায়তা করা ।

১. বস্তুবাদঃ

বস্তু সকল শক্তি ও ক্ষমতার মূল। বস্তুর উন্নতি সাধনের মাধ্যমেই রাষ্ট্র। সমাজ তথা বিশ্বের সামগ্রীক উন্নতি সাধন সম্ভব। এই মতবাদ অনুযায়ী ৫টি বিষয়ে বিশ্বাস স্থাপন হচ্ছে চরম বোকামী। এগুলো হলোঃ
ক. সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাস,
খ. ধর্মগ্রন্থে বিশ্বাস,
গ. তীর্থ স্থান ভ্রমন,
ঘ. কৃচ্ছতা সাধন বা উপবাস যাপন ও
ঙ. পরকাল বা পূণর্জন্মবাদে বিশ্বাস।
নাস্তিক্যবাদের মূল ভিত্তি হলো এই বস্তুবাদ।

পৃথিবীতে যত ভ্রান্ত মতবাদ রয়েছে তার অধিকাংশের মূলে রয়েছে বস্তুবাদ। সমাজতন্ত্র,ধর্ম নিরপেক্ষতাবাদ, পুঁজিবাদ এবং পাশ্চাত্যের গনতন্ত্রের মূল ভিত্তিও বস্তুবাদ। বস্তুবাদ মানুষকে নীতিহীন বর্বর জানোয়ারে পরিনত করতে পারে। জাতিয়তাবাদের ভয়াবহতার বিস্তার বস্তুবাদের উপর বিশ্বাসের কারনেই ঘটে থাকে।

২.গনতন্ত্রঃ

এমন এক রাজনৈতিক ব্যাবস্থা যেখানে দেশের সর্বময় কতৃত্ব একটি নির্দিষ্ট সংখ্যক প্রতিনিধির কাছে থাকে এবং এই প্রতিনিধিরা জনগন কতৃক নর্বাচিত হয়ে থাকে। গনতন্ত্রকে প্রধানতঃ দুই ভাগে ভাগ করা হয় যেমনঃ ক. প্রত্যক্ষ গনতন্ত্র ও খ. পরোক্ষ গনতন্ত্র

দুর্বলতাঃ

১. জনগন সার্বভৌম ক্ষমতার মালিক নয়। যদিও গনতন্ত্রে তাই দাবী করা হয়।
২. জনগন সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহন করতে পারেনা।
৩. নির্বাচিত ব্যক্তিদের মাঝে স্বৈরাচারী মনোভাবের বিকাশ ঘটে।
৪. কেবলমাত্র রাজনৈতিক মতবাদ। কোন পরিপূর্ন জীবন ব্যবস্থা নয়।
৫. গনতন্ত্রের বহুমুখী চরিত্রের কারনে এর প্রাতিষ্ঠানিকরুপ স্থায়ীত্ব পায়না।

৩. জাতীয়তাবাদঃ

জাতীয়তাবাদ এমন একটি মতবাদ যা একটি জনপদের মানুষের ভাষা, বর্ণ, ধর্ম, অঞ্চল, সংস্কৃতি প্রভৃতি সেন্টিমেন্টের উপর নির্ভর করে গড়ে ওঠে। যেমন বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ, বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ, কৃষ্ণাঙ্গ বা স্বেতাঙ্গ জাতীয়তাবাদ, নাৎসীবাদ, ফ্যাসিবাদ, হিন্দু বা মুসলিম জাতীয়তাবাদ ইত্যাদি।

দুর্বলতাঃ

১. নিজের জাতির প্রতি অন্ধ ভালবাসার কারনে অপর জাতির লোকেরা নিগৃহিত হয়।
২. নিজের জাতির শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য অপরের সকল অধিকার হরনে কুন্ঠিত হয় না।
৩. জাতির উপর জাতির কৃতত্ব, দখলদারিত্ব, যুদ্ধ,আগ্রাসন সকল কিছুর মূলে কাজ করে এই জাতীয়তাবাদ।
৪. মানবতাবাদের চরম দুশমন এ মতবাদটি কোন একটি জাতিকে উন্নতির চরম শিখরে পৌছাতে পারলেও প্রকৃত প্রস্তাবে এই উন্নতি বিশ্ব শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য চরম হুমকি।

৪. ধর্মনিরপেক্ষতাবাদঃ

এটা এমন এক রাষ্ট্রচিন্তা যার কোথাও ধর্মীয় বিশ্বাসের অস্তিত্ব স্বীকার করা হয় না। রাষ্ট্র সীমিত মাত্রায় ব্যক্তি পর্যায়ে ধর্ম পালনের স্বীকৃতি দিলেও এটি একটি বস্তুবাদী রাজনৈতিক দর্শন যা ধর্মকে নির্মূল করার সকল পদক্ষেপই গ্রহন করে থাকে।

দুর্বলতাঃ

১. রাষ্ট্রযন্ত্র ধর্মকে নিরুতসাহিত ও নিষিদ্ধ করে।
২. রাষ্ট্রের উপর ধর্ম বা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের কতৃত্ব কঠোরভাবে দমন করে।
৩. এ মতবাদটি রাষ্ট্রের সাথে ধর্মের বিষয়ে আলোচনা করে।
৪. এটি একটি অসম্পূর্ণ মতবাদ যা মানব জীবনের অন্য কোন সমস্যা সম্পর্কে কোন সমাধানই দিতে পারেনা।

৫. সমাজতন্ত্র ও কমিউনিজিমঃ

যে ধরনের রাষ্ট্র বা রাজনৈতিক ব্যবস্থায় সকল সম্পদ ও ক্ষমতার মালিক রাষ্ট্র, ব্যক্তিমালিকানা ও সম্পদ অর্জন সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ, সবাই রাষ্ট্রের জন্য কাজ করে, রাষ্ট্র জনগনের নূন্যতম চাহিদাপূরন করে সেই রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে সমাজতন্ত্র বলা যায়। এটি একটি বস্তুবাদ নির্ভর নাস্তিক্যবাদী মতবাদ।

দুর্বলতাঃ

১. ব্যক্তির মত প্রকাশের স্বাধীনতা কঠোরভাবে দমন করা হয়।
২. ধর্মীয় কার্যক্রম সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করা হয়।
৩. দল বা শাসকশ্রেনী চরম স্বৈরাচারী হয়ে থাকে। ভোগ-বিলাসের ক্ষেত্রে তারা নিরংকুষ কতৃত্ব ভোগ করে থাকে।
৪. মানুষের যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ আদায় করা হলেও মজুরী ও সন্মান সবার সমান।
৫. কেবলমাত্র অর্থনৈতিক দর্শন। মানব জীবনের সামগ্রীক সমস্যার সমাধানে ব্যর্থ।

৬. পুঁজিবাদঃ

ব্যক্তিমালিকানা এই মতবাদের মূলভিত্তি। এ ব্যবস্থায় ব্যক্তিই সম্পদের মালিক। এতে অন্যের কারো কোন রকম অধিকার নেই। ব্যক্তি স্বার্থপরতার নিকৃষ্টতম উদাহরন পুজিবাদ।

দুর্বলতাঃ

১. সমাজে ধনী ও দরিদ্রের মাঝে বৈষম্য সৃষ্টিকরে।
২. পুজিপতিরাই রাষ্ট্রকে নিয়ন্ত্রন করে থাকে।
৩. বুর্জোয়া ও প্রলেতারিয়েত শ্রেনীর মাঝে দ্ধন্দ্ব সৃষ্টি হয়।
৪. সুদ এই অর্থনীতির মূল হাতিয়ার।
৫. আয় বা ব্যয়ের ক্ষেত্রে রাষ্ট্র, সমাজ বা নৈতিকতার কোন বাধাই পূঁজিপতিদের নিয়ন্ত্রনের ক্ষমতা রাখেনা।
৬. এটি কোন জীবন দর্শন নয় বরং সম্পূর্ণভাবে এটি অর্থনৈতিক মতবাদ।

ইসলামঃ

১. অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যত সকল যুগেই ইসলাম শ্রেষ্টতম ও একমাত্র নির্ভুল জীবন ব্যবস্থা।
২. ইসলাম আল্লাহর মনোনীত একমাত্র দ্বীন।
৩. যুগে যুগে নবী রাসূলগন মানবজাতীর কাছে এই দ্বীনকে তুলে ধরেছেন। আমাদের নবী হযরর মুহাম্মদ (সঃ) এর আগমনের মাধ্যমে নবী রাসূল প্রেরণের সিলসিলার পরিসমাপ্তি ঘটেছে।
৪. ইসলাম পরপূর্ণ জীবন ব্যবস্থা। যার অনুসরন মানুষের ইহকালে শান্তি, নিরাপত্তা ও সন্মান নিশ্চিত করে। একইভাবে পরকালীন নাযাতের পথ প্রদর্শন করে।
৫. ইসলাম মানবজাতীর ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক সমস্যাসহ সকল সমস্যার নিশ্চিত ও শ্রেষ্টতম সমাধান দিতে সক্ষম।

অতএব ইসলামই মানব জাতীর মুক্তির একমাত্র পথ।

ধর্ম ও বিজ্ঞান ভাবনা

মুহাম্মাদ আব্দুল মান্নান

এক

ধর্ম ও বিজ্ঞান নিয়ে বিস্তর কথাবার্তা আছে আমাদের মাঝে। ধর্মের সাথে বিজ্ঞানের সংঘর্ষ নাকি সন্ধি এটা নিয়েও যথেষ্ঠ সন্ধিহান আমরা অনেকেই। কোন কোন ধর্মের সাথে রক্তা রক্তির ঘটনাও আছে ইতিহাসের পাতায় এ নিয়ে। তবে পবিত্র কুরআন থেকে উৎসারিত ধর্ম, ইসলামের সাথে প্রকৃত বিজ্ঞানের বিরোধ ছিলনা অতীতে, বর্তমানেও নেই এবং ভবিষ্যতেও হবেনা কখনও। ধর্ম ও বিজ্ঞান নিয়ে প্রাসঙ্গিক কিছু কথার প্রতিফলন ঘটবে এ লেখার মধ্য দিয়ে।
এক ঐশী বাণীর বা অহির মাধ্যমে মানুষের জীবন পরিচালনার জন্য সামগ্রিক দিক নির্দেশনাকে সাধারণ ভাবে ধর্ম হিসাবে বুঝানো হয়ে থাকে। প্রাকৃতিক জগতকে জানার এটা একটা মাধ্যমও বটে। মানুষ বিভিন্ন বিশ্বাসের ভিত্তিতে কিছু আচার অনুষ্ঠান ও প্রাত্যহিক কাজের মধ্য দিয়ে ধর্ম পালন করে থাকেন। বিশ্বাসই হচ্ছে ধর্মের মূল কথা। মহাপ্রভুর পক্ষ থেকে নির্বাচিত এক দল মহামানব (নবী ও রাসুল) তাঁরই দ্বারা আদিষ্ট হয়ে মানব জাতিকে বিশ্বাস ও আচার অনুষ্ঠানের শিক্ষা দিয়েছেন। এ সব মহামানবগণের প্রতি আস্থা রেখেই ধর্মপ্রাণ লোকেরা ধর্ম পালন করে থাকেন। বিশ্বাসীগণ তাঁদের (মহামানবগণের) প্রচারিত বাণীর স্বপক্ষে যুক্তি অথবা প্রমাণ দাবি করেননি কোন সময়ই। কারণ একটাই, আর তা হল মহামানব গণের প্রতি অগাধ আস্থা।

সুব্যবস্থিত জ্ঞান ও কাজকে আমরা সাধারণ ভাবে বিজ্ঞান বলতে পারি। প্রাকৃতিক জগত ও বস্তু সন্বন্ধে জানার আরও একটি ব্যবস্থা। এ ব্যবস্থায় পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তুর বর্ণনা ও ব্যাখ্যা প্রদান করা হয়ে থাকে। প্রকৃতি ও পদার্থের বর্ণনা এবং ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে যে সব তত্ত্ব ও তথ্য উপস্থাপন করা হয় তা সকল মানুষের নিকট বোধগম্য হবে এমনটি কেউই জোর করে দাবি করতে পারবেনা। উক্ত বিষয়ের ওপর কোন ব্যক্তির যদি যথাযথ জ্ঞান থাকে তাহলেই তা সে রপ্ত করতে সক্ষম হবে। দৃষ্টি শক্তির সমস্ত ক্ষমতা ব্যবহার করে গোচরীভূত সীমানার শেষ প্রান্ত পর্যন্ত দেখতে পাওয়া সমতল পৃথিবীটাকে কারো নিকট গোলাকার বা তদ্রুপ আকারের প্রমাণ করতে হলে তার নিকট যুক্তি পেশ করতে হবে। কারণ বিজ্ঞানের মূল কথাই হচ্ছে যুক্তি ও প্রমাণ। ব্যক্তিটি যদি জ্ঞানী হন তা হলে খুব একটা সমস্যা হয়তো হবেনা । কিন্তু বিপত্তি ঘটবে তখনই, যখন কোন ব্যক্তি যুক্তি বুঝতে অক্ষম হবেন। সমস্ত পৃথিবীটাকে তো আর হাতের মুঠোয় পুরে তাকে বুঝানো সম্ভব নয়। তাহলে যুক্তি না বোঝা ব্যক্তির উপায় কি? উপায় একটাই, আর তা হল যুক্তিবাদীদের কথা অন্ধ ভাবে হুবহু বিশ্বাস করা। উল্লেখ্য যুক্তি বুঝতে অক্ষম ব্যক্তিদের সংখ্যাই পৃথিবীতে বেশী। এ সকল মানব সন্তান যুক্তিবাদীদের উপর আস্থা রেখেই কিন্তু দিব্যি ঘর সংসার চালিয়ে যাচ্ছেন।

কোন ব্যক্তি যদি ধর্মের অনুশাসন গুলি সঠিক ভাবে ও পুঙ্খানুপুঙ্খ রূপে মানার ব্যাপারে ব্রতী হন তাহলে তাঁকে সমাজে নতুন নামে আখ্যায়িত করা যায় কিনা এ ব্যাপারে কিছু লোকের মগজে নতুন নতুন বুদ্ধি গজাতে থাকে। ফল স্বরূপ বেরিয়ে আসে ধর্মান্ধ, মৌলবাদ, কট্টরপন্থী সহ আরো অনেক শব্দ গুচ্ছ। শুধু কি তাই? সমাজে তাঁকে কিভাবে কোনঠাসা করে রাখা যায় সে জন্য আবিস্কার হতে থাকে নব নব কলা কৌশল। ফলে বেচারা সময়ের চাকা ঘুরাতে থাকেন অব্যক্ত এক মর্মপিড়া নিয়ে। অপর পক্ষে কোন ব্যক্তি যদি বিজ্ঞানের ব্যাপারে একই পন্থা অবলম্বন করে থাকেন তাহলে তাঁর বিদ্যা বুদ্ধির স্বীকৃতি স্বরূপ বুদ্ধিজীবী, বিজ্ঞানী, প্রগতিশীল, সুশীল ও আরো অনেক শিহরণ সৃষ্টিকারী শব্দ ব্যবহার হয়ে থাকে নামের সাথে। সমাজে নিজের অবস্থান সম্পর্কে ভাবতে থাকেন অন্যভাবে।

ধর্মান্ধ শব্দটি অনেক আগেই অভিধানে স্থান করে নিতে পারলেও বিজ্ঞানান্ধ শব্দটি যতদুর জানা যায় এখন পর্যন্ত অনাবিস্কৃতই রয়ে গেছে। ধর্মের সঠিক দিক নির্দেশনা অনুসরণ করতে গিয়ে যদি কেউ ধর্মান্ধ হন তাহলে বিজ্ঞানের ব্যাপারেও তো একই কথা প্রযোজ্য হওয়া উচিত। স্বঘোষিত সুশীল সমাজ বলতে পারে, ধর্ম পালনকারী লোকদেরকে কস্মিন কালেও ধর্মান্ধ বলা হয় না বরং ধর্মের ব্যাপারে উন্মত্ততা প্রদর্শনকারীদেরকেই তা বুঝানো হয়ে থাকে। কিন্তু বর্তমান সমাজে, ঘোরাফেরা করে আমরা কি উপরোক্ত যুক্তির সত্যতা খুঁজে পাই? বরং সত্য মিথ্যার সংমিশ্রণে এবং তথাকথিত ধর্ম নিরেপেক্ষতার আবরণে বিজ্ঞানের ধ্বজাধারী হয়ে সুশীল সমাজের ছদ্মাবরণে নিজেদের মতাদর্শকে (ইসলাম পরিপন্থী) প্রতিষ্ঠা করার উদ্দেশ্যেই তারা ধর্মের ব্যাপারে সর্বদাই খড়গহস্ত।

উপরোক্ত আলোচনা থেকে এটা প্রতীয়মান হয় যে ধর্ম এবং বিজ্ঞান উভয়ের প্রতি সমর্থন আছে এরূপ বিশাল এক জনগোষ্ঠী আস্থা রাখে হয়তোবা নবী-রাসুলদের প্রতি নয়তোবা বিজ্ঞানীদের প্রতি। ইতিহাসের পাতা এবং বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে আমরা দেখতে পাই, অনেক তত্ত্ব এক কালে বৈজ্ঞানিক ভাবে সত্য বলে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিল। কিন্তু কালের আবর্তনে তা মিথ্যায় পর্যবসিত হয়েছে। যেমন, এক সময় বিজ্ঞানীরা মনে করতেন আমাদের এ মহাবিশ্বের কোন শুরু ছিলনা। অনাদিকাল থেকে এমনটি ছিল এবং এমনই থাকবে, এর কোন ধ্বংস নেই। অধুনাকালে আগের ধারণার বিলুপ্তি ঘটেছে। মহাবিশ্বের শুরু ছিল এবং তা একদিন ধ্বংস হবে এ ধারণা স্বীকৃতি লাভ করেছে।

কেউ যত বড়ই বিজ্ঞানী হোননা কেন মানুষ হিসেবে তাঁর জ্ঞানের একটা সীমাবদ্ধতা থাকতে বাধ্য। তাহলে সকল ক্ষেত্রে কি বিজ্ঞানীদের উপর আস্থা রাখা যায়? আমাদেরকে যখন কারো উপর আস্থা রাখতেই হবে তখন মহান প্রভুর পক্ষ থেকে নির্বাচিত ও হেদায়াত প্রাপ্ত লোকদের প্রতি আস্থা রাখা এবং তাঁদের প্রদর্শিত পথে চলাটা কি অধিক যুক্তি গ্রাহ্য নয়? তবে কুরআন সুন্নাহর সাথে সাংঘর্ষিক নয় এমন সব বিষয়ের উপরে বিজ্ঞানীদের প্রতি আস্থা রাখতে আপত্তি নেই।

দুই

মুসলিম পরিবারে জন্ম গ্রহণ করার সুবাদে ইচ্ছায় হোক বা অনিচ্ছায় বিভিন্ন মাধ্যম দ্বারা পবিত্র কুরআনের অনেক বাণীর সাথে পরিচয় ঘটেছিল বাল্যকাল থেকেই। লেখাপড়ার পরিধি কম হওয়ায় গবেষণার দৃষ্টি ভঙ্গি থেকে কুরআনে আলোচিত বিষয় গুলোকে বিশ্লেষণ করা এবং বুঝা কষ্টসাধ্য ব্যাপার ছিল আমার নিকট। তারপরও আলেম উলামাদের ও সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত কিছু ব্যক্তি বর্গের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে যে সাহিত্য সম্ভার সৃষ্টি হয়েছে তা থেকে এবং তাঁদের আলোচনা থেকে আমি যে অনুপ্রেরণা লাভ করেছি সে জন্য আল্লাহ্‌র নিকট তাঁদের জন্য কল্যাণ কামনা করছি।

কোন কোন ব্যক্তির লেখনি বা আলোচনা থেকে আমাদের মুসলিম সমাজে এমন একটা আবহ সৃষ্টি হয়েছে যার ফলশ্রুতিতে অল্প শিক্ষিত, অর্ধ শিক্ষিত এবং শিক্ষিত অধিকাংশ মুসলমানেরা মনে করেন বিজ্ঞানের সকল আবিস্কারই হয়েছে কুরআন থেকে। আর অমুসলিমরা তা করেছে রীতিমতো কুরআন থেকে চুরি করে। আমিও কিন্তু ঐ মুসলমানদের মধ্যে একজন। বিশ্বাসও করতাম তাঁদের মত করে পাছে গুনাহ হয়ে যায় এ ভয়ে। কুরআনের ব্যাপারে এ ধরণের প্রচারণার কারণে কোন ব্যক্তি যদি এটাকে বিজ্ঞানের বই ভেবে বিজ্ঞান শিক্ষার উদ্দেশ্যে পড়তে শুরু করেন তাহলে তিনি বেকায়দায় পড়বেন নিঃসন্দেহে। কারণ প্রচলিত বিজ্ঞানের বইয়ের মতো তো আর কুরআন বিজ্ঞানের বই নয়। আল্লাহ্‌ সুব্‌হানু তায়ালা বলেননিও তা। কুরআনের পক্ষে আল্লাহ্‌র ঘোষণা, “এটা একটা সন্দেহ মুক্ত কিতাব (গ্রন্থ) এবং মুত্তাকীদের জন্য এতে রয়েছে হেদায়াত”। তবে তাঁর বান্দাহদের মনজগতকে আলোড়িত করার জন্য বিজ্ঞান সম্মত অনেক আয়াতও নাজিল করেছেন তিনি। এতে করে একথা বুঝে নেয়া ঠিক নয় যে প্রচলিত বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের মত সেগুলিও হুবহু একই রকম তত্ত্ব। কুরআন থেকে বিজ্ঞানের নব নব আবিস্কারের কথাটা কুরআনে বিশ্বাসী লোকদের নিকট স্বাভাবিক মনে হলেও একজন অবিশ্বাসীর জন্য তা হবে অসামঞ্জস্যশীল একটা উক্তি। আর এ ধরনের উক্তির কারণেও হয়তো অনেকে থেকে যেতে পারেন অনেক -দুরে কুরআন নাজিলের আসল উদ্দেশ্য থেকে।

কুরআন থেকে কি ভাবে বিজ্ঞানের ব্যাপারে নির্দেশনা পাওয়া যেতে পারে তার একটা উদাহরণ এখানে পেশ করছি। আপনারা অনেকেই ‘মহাবিষ্ফোরণ তত্ত্ব’ (Big Bang Theory) সম্বন্ধে অবগত আছেন। বর্তমান বিশ্বের অধিকাংশ বিজ্ঞানী বিশ্বাস করেন মহাবিষ্ফোরণের মাধ্যমে আমাদের এই মহাবিশ্বের যাত্রা শুরু হয়েছিল। এ তত্ত্বটি আবিস্কারের পেছনে নিয়ামক হিসাবে ‘মহাবিশ্বের সম্প্রাসারণ তত্ত্ব’টি বিশেষ ভাবে কাজ করেছে। ১৯২২ সালে রাশিয়ার একজন বিজ্ঞানি আলেকজান্ডার ফ্রেইডম্যান আমাদের মহাবিশ্ব স্থির নয় ‘সম্প্রসারণশীল’ এ তত্ত্ব উপস্থাপন করেন। পরবর্তীতে জর্জ মেইটর, একজন বেলজিয়ান মহাকাশ বিজ্ঞানী, ‘সম্প্রাসারণশীল মহাবিশ্ব’ তত্ত্বটিকে কাজে লাগিয়ে ‘মহাবিষ্ফোরণ তত্ত্বের’ নমুনা বিশ্ববাসীর সামনে পেশ করেন।

এখন পবিত্র কুরআনের সূরা যারিয়াতের ৪৭ নং আয়াতে দৃষ্টি নিবদ্ধ করি। আল্লাহ্‌ পাক বলেন,”আমি আকাশ নির্মাণ করেছি আমার ক্ষমতাবলে এবং আমি মহাসম্প্রসারণকারী”। বিজ্ঞানের চরম উৎকর্ষতা এবং উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন প্রযুক্তি ব্যবহার করে মহাকাশের সম্প্রসারণ সম্বন্ধে সম্প্রতিককালে জ্ঞান লাভ করেছেন বিজ্ঞানীগণ। অথচ সাড়ে ১৪০০ বছর পূর্বের এক অন্ধকার যুগে তা অংকিত হয়েছিল পবিত্র কুরআনে। একই ভাবে বিজ্ঞানের আরো অনেক নিদর্শন ছড়িয়ে রয়েছে কুরআনের বিভিন্ন পাতায়। আর তা অনুধাবন করার জন্য দরকার এমন সব বিশ্লেষকের যাঁরা সঠিক অর্থেই হবেন কুরআন বিশারদ এবং যাঁদের থাকবে অধুনা কালের বিজ্ঞানের জগতে বাস্তব পদচারণা।

কুরআন গবেষকদের মধ্যে একদল রয়েছেন যাঁরা আল্লাহর দেয়া হুকুম গুলি চুলচেরা বিচার বিশ্লেষণের মাধ্যমে উপস্থাপন করেন আমাদের সামনে। ফলে তা শিরক বিদায়াত সহ নানা ধরনের আল্লাহর নাফরমানী মূলক কাজ থেকে দুরে অবস্থান করে তাঁর খাঁটি গোলাম হতে সাহায্য করে আমাদেরকে। এ কাজের জন্য সাধুবাদ পেতে পারেন তাঁরা। তবে চলমান বিশ্বের ঘটনা প্রবাহ বিশেষ করে বিজ্ঞানের জগতে কুরআন কি ধরণের অবদান রাখতে পারে তা নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামাননা এ দলের গবেষকগণ। তার কারণ, বিজ্ঞানের জগতে তাঁদের পদচারণা খুবই কম। বিজ্ঞান হচ্ছে যুক্তি তর্কের ব্যাপার, কাজেই ধর্ম বিশ্বাসের সাথে যুক্তি তর্ক গুলিয়ে ফেলতে নারাজ তাঁরা ।

গবেষকদের মধ্যে আর একটি দল যাঁরা স্রষ্টার সৃষ্টির ব্যাপারে নাযিলকৃত আয়াত দ্বারা উদ্দীপ্ত হয়ে কুরআনের বিভিন্ন আয়াতের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দিয়ে থাকেন। ধর্ম গ্রন্থের (কুরআন) নিদর্শনের সাথে বিজ্ঞানের বিভিন্ন আবিস্কারের মধ্যে সামঞ্জস্য খুঁজে বের করার জন্য বুদ্ধিদীপ্ত এ দলের গবেষকগণ এক যোগে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন দেশে ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে । গবেষণার মাধ্যমে বিজ্ঞানের তত্ত্ব গুলি আত্মস্থ করে কুরআনের ভাষায় আবার তা প্রকাশ করা নেহায়েতই ছেলে খেলা নয়। এটাও একটা জটিল কাজ হওয়ায় নিঃসন্দেহে তাঁরাও সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য। বিশ্ববাসীর সামনে কুরআনের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণই যে তাঁদের উদ্দেশ্য তা সহজেই অনুমেয়। কিন্তু শুধুমাত্র সামঞ্জস্য খোঁজার মাধ্যমে কি শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করা সম্ভব?

উপরে উল্লেখিত বুদ্ধি দীপ্ত দ্বিতীয় দলের গবেষকদের অবদানের কথা স্মরণে রেখে এবং তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলতে চাই আল্লাহ্‌ যা স্পষ্ট করে প্রকাশ করেননি তা আমাদের ও তাঁর অন্যান্য সৃষ্টির জন্য জানা বা অনুমান করা একেবারেই অসম্ভব ব্যাপার। কাজেই সামঞ্জস্য খুঁজতে গিয়ে নিশ্চয় করে বলা কঠিন যে পবিত্র কুরআনে আল্লাহ্‌ পাক মহাবিষ্ফোরণ তত্ত্ব, কৃষ্ণ গহ্বর, গ্যালাক্সি বা অন্য যে কোন তত্ত্বের কথাই হুবহু বলেছেন বিভিন্ন আয়াতের মধ্য দিয়ে। আমরা জানি বিজ্ঞানের তত্ত্ব পরিবর্তনশীল। আজ যা বৈজ্ঞানিকভাবে সত্য কাল তা মিথ্যাও হতে পারে। অপর পক্ষে কুরআন সকল যুগের মানুষের জন্য এক অমোঘ বাণী।

পবিত্র কুরআন যে সর্বশ্রেষ্ঠ কিতাব- তা প্রমাণ করতে হলে কুরআনের সকল বিভাগের জ্ঞানের সাথে বর্তমান কালের জ্ঞান বিজ্ঞানের কলা কৌশলও আয়ত্বে আনতে হবে আমাদেরকে। তার জন্য দরকার গবেষকগণের একই প্লাটফরমে এসে কাজ করা। যে জ্ঞান এক সময় পৃথিবীবাসীকে করেছিল আলোকিত ও ধন্য, তা অনুসন্ধান করতে হবে আমাদের দায়িত্ব হিসাবেই। ধর্ম তথা কুরআনের সাথে প্রকৃত বিজ্ঞানের সংঘর্ষ ছিলনা কোন কালেই। আর যদি থেকে থাকেও, তা হয়েছে আমাদের জ্ঞানের অভাবের কারণে। কাজেই কুরআন থেকে একদেশদর্শী জ্ঞান নয় বরং বহুমূখী জ্ঞান অর্জনই হতে পারে কুরআনকে শ্রেষ্ঠ প্রমাণ করার কর্যকরী পদক্ষেপ।

মানবতার ধর্ম ইসলাম

প্রথম পর্ব

ইসলাম একটি পরিপূর্ণ এবং সামগ্রিক জীবন বিধান হিসেবে ইতোমধ্যেই বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। বিশেষ করে জ্ঞানী গুণী বিশেষজ্ঞগণ মহান এই ধর্ম নিয়ে পড়ালেখা করতে গিয়ে এই ধর্মের প্রকৃত শিক্ষা ও স্বরূপের সাথে পরিচিত হবার সুযোগ পান। যার ফলে শত্রুদের তাবৎ ষড়যন্ত্র সত্ত্বেও বিশ্বব্যাপী ইসলামের বিকাশ ব্যাপক বৃদ্ধি পেয়েছে। আসলে ইসলামের নীতিমালা এবং শিক্ষাগুলো জুলুম অত্যাচার নিপীড়নের বিরোধী হবার কারণে বিশ্বের বলদর্পী শক্তিগুলোর স্বার্থের পথে তা মারাত্মক অন্তরায়। যার ফলে আধিপত্যবাদী শক্তিগুলো ইসলামের প্রকৃত স্বরূপ এবং তার বিকাশের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করার জন্যে তাদের সর্বপ্রকার সামর্থ ও শক্তিকে কাজে লাগাচ্ছে। আমরা তাই এই আসরে ইসলামের প্রকৃত স্বরূপ ও বিভিন্ন দিক তুলে ধরার চেষ্টা করবো।

সূচনালগ্ন থেকেই ইসলাম শত্রুতার মুখে পড়েছিল। আজও সেই শত্রুতা অব্যাহত আছে। তবে বর্তমানে পশ্চিমা বলদর্পী শক্তিগুলো ইসলামের বিরুদ্ধে শত্রুতার নতুন কৌশল অবলম্বন করেছে। তারা এখন বিশ্বব্যাপী ইসলামভীতি ছড়ানোর চেষ্টা করছে। তারা ইসলামকে যুদ্ধ ও সহিংসতার ধর্ম এবং মানবাধিকার উপেক্ষাকারী বলে প্রচার করার চেষ্টা করছে। এসব করে তারা বিশ্ববাসীকে ইসলাম বিমুখ করে রাখতে চায়। তবে নামসর্বস্ব কিছু মুসলমানের কাজকর্ম পশ্চিমাদের ঐসব প্রচারণার অনুকূলে গেছে। যেমন- আল কায়েদা ও তালেবান। এই গোষ্ঠিগুলো সহিংসতাকামী,নির্দয় এবং সন্ত্রাসী কাজে লিপ্ত থেকেও নিজেদের মুসলমান বলে পরিচয় দেয়। এদিকে গণমাধ্যমগুলো তাদের ভয়াবহ কর্মকাণ্ডগুলোকে ফলাও করে প্রচার করছে,যেসব দেখলে যে কোনো মানুষই মুসলমানদের ব্যাপারে ঘৃণ্য ও অবজ্ঞাপূর্ণ মনোভাব পোষণ করবে। পশ্চিমাদের ব্যাপক অপপ্রচারণার ফলে যে-কোনো সাধারণ মানুষ বা অসচেতন মানুষ ঐসব সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডকে ভুল করে ইসলাম এবং মুসলমানদের কার্যক্রম বলে ভাবতে পারে।
তবে সুখকর ব্যাপারটি হলো,বিশ্বের প্রকৃত মুসলমানদের বিশাল অংশটি মুসলিম নামধারী ঐসব সন্ত্রাসী গোষ্ঠির কার্যক্রমে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন এবং ঐসব গোষ্ঠিকে বিচ্যুত বলে মত দিয়েছেন। পশ্চিমারা যেহেতু ইসলামের শক্তিশালী ও উন্নত সংস্কৃতিকে যুক্তি দিয়ে মোকাবেলা করতে সক্ষম নয় সেহেতু তারা ইসলামের অগ্রগতিতে শঙ্কিত হয়ে ইসলামের বিরুদ্ধে অপপ্রচারণার আশ্রয় নিয়েছে। বিশেষ করে যারা ইসলামের ব্যাপারে আগ্রহী তাদেরকে ফিরিয়ে রাখার স্বার্থে ইসলামকে সন্ত্রাসী বলে প্রচারণা চালাচ্ছে। সেজন্যে এখন সবার মনেই একটি প্রশ্ন দেখা দিয়েছে-ইসলাম কি আসলেই সন্ত্রাসী বা সহিংসতার ধর্ম?ধারাবাহিক এই আসরে আমরা এ প্রশ্নের জবাব দেওয়ার চেষ্টা করবো। সেইসাথে প্রেম ভালোবাসা স্নেহ ও কল্যাণ আর মানবতার মুক্তির ধর্ম ইসলামের বিশেষ কিছু দিক ও তাৎপর্য তুলে ধরার চেষ্টা করবো।

পবিত্র কোরআন নিয়ে সামান্য পড়ালেখা করলেই অসংখ্য উদাহরণ পাওয়া যাবে যা থেকে বোঝা যাবে ইসলাম একটি দয়া,অনুগ্রহ ও কল্যাণের ধর্ম।আল্লাহর অনুগ্রহের কথা,করুণার কথা দয়ার কথায় কোরআন পরিপূর্ণ। কোরআনের প্রতিটি সূরা শুরু করতে হয় এমনকি মুসলমানদের প্রতিটি কাজ শুরু করতে হয় বিসমিল্লাহ বলে। এর অর্থই হলো সেই আল্লাহর নামে শুরু করছি যিনি পরম করুণাময় এবং দয়াবান।কোরানের ১১৪ টি সূরার মধ্যে ১১৩ সূরা এই বিসমিল্লা বলে শুরু হয়েছে। কোরআনের অসংখ্য আয়াতে বলা হয়েছে আল্লাহ তাঁর বান্দাদের প্রতি অসম্ভব দয়ালু,তিনি ক্ষমাকারী এবং মেহেরবান ইত্যাদি। তো যেই ধর্মের মূল গ্রন্থটির সূচনা হয়েছে আল্লাহর দয়া আর রহমতের ঘোষণা দিয়ে সেই ধর্ম কি সহিংস হতে পারে?
কোরআনের আয়াতগুলোর প্রতি মনোযোগী হলে দেখা যাবে আল্লাহর অনুগ্রহ,করুণা এবং দয়ার্দ্রতার বিষয়টি চমৎকারভাবে ফুটে উঠেছে। সেখানে লক্ষ্য করা যাবে আল্লাহর এই দয়ার ব্যাপারটি কেবল যে ইসলাম ধর্মের অনুসারীদের জন্যে তা নয়, বরং সমগ্র মানব জাতির জন্যেই প্রযোজ্য। এ কারণে ইসলাম ধর্মও কেবল মুসলমানদেরই নয় বরং সমগ্র মানব জাতির ধর্ম।সূরায়ে জাসিয়ার চৌদ্দ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছেঃ “হে নবী! আপনি মুমিনদেরকে বলুন, তারা যেন তাদেরকে ক্ষমা করে,যারা কিয়ামত বা পুনরুত্থান দিবসের প্রতি বিশ্বাস রাখে না, যাতে তিনি কোন সম্প্রদায়কে তাদের কৃতকর্মের প্রতিফল দেন ।”আল্লাহ রাব্বুল আলামিন এই আয়াতে মুসলমানদের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছেন তারা যেন অমুসলমানদের ব্যাপারে সহানুভূতিশীল হয় এবং তাদের মন্দ দিকগুলোকে না দেখার ভান করে বা উপেক্ষা করে যায়। তো এরকম একটি ধর্মকে কী করে সহিংস বলা যায়!

আসলে আল্লাহর রহমত বা দয়ার ভাণ্ডার অফুরন্ত,অসীম। কিন্তু কিছু কিছু লোক বিচ্যুতির পথে পা বাড়িয়ে নিজেদের মনুষ্যত্বকে ধ্বংস করে ফেলে আল্লাহর রহমতের ব্যাপার হতাশ কিংবা বঞ্চিত হয়ে পড়েছে। তাদেরকে সঠিক পথ দেখানোর জন্যেই আল্লাহ নবী রাসূলদের পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। এরকমই একজন নবী হলেন ইব্রাহিম (আ)।তিনি লুতের কওমকে আসন্ন বিপদ থেকে মুক্তি দেওয়ার জন্যে ব্যাপক চেষ্টা চালান। আল্লাহর কাছে তাদের জন্যে ক্ষমা প্রার্থনা করেন। সাধারণত নবীরা আল্লাহর পক্ষ থেকে মানব জাতিকে সুসংবাদ এবং সতর্কতা প্রদানকারী হিসেবেই আবির্ভূত হন। ঐ সতর্কতাও আল্লাহর পক্ষ থেকে দয়া ও অনুগ্রহ,যাতে তারা বিচ্যুতি থেকে সঠিক পথে ফিরে আসেন এবং সৌভাগ্যের প্রশস্ত পথে অগ্রসর হয়। এই সতর্কতাও অনুগ্রহ। সেজন্যেই রাসূলের পরিচয় সম্পর্কে কোরআনে বলা হয়েছেঃ ‘আমি আপনাকে বিশ্ববাসীর জন্যে রহমত স্বরূপই প্রেরণ করেছি।’ সেজন্যেই আমরা লক্ষ্য করবো মূর্তিপূজকরা পর্যন্ত যখন নবীজীকে বিশ্রি ভাষায় গালিগালাজ করতো তখনো তিনি ধৈর্যের সাথে বরণ করতেন কখনোই তাদেরকে পাল্টা গালি দেন নি,তাদেরকে অভিশাপ দেন নি। কোরআনে তাই বলা হয়েছে ‘নিশ্চয়ই আপনি সবোর্ত্তম চরিত্রের অধিকারী।

সূরা আল-ইমরানের একশ’ উনষাট নম্বর আয়াতে রাসূলের এই কোমল ও সহৃদয় হবার প্রতি ইঙ্গিত করে বলা হয়েছেঃ ‘আল্লাহর রহমতেই আপনি তাদের জন্য কোমল হৃদয় হয়েছেন পক্ষান্তরে আপনি যদি রাগ ও কঠিন হৃদয় হতেন তাহলে তারা আপনার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতো।’এটা ছিল সত্যিকারের এক অলৌকিক ব্যাপার। কেননা নবীজীর আবির্ভাবের আগে আরবের লোকেরা যেখানে খুনখারাবি ছাড়া কিছুই বুঝতো না, সেখানে নবীজীর আগমনের পর তাঁর এই ধৈর্যশীলতা ও কোমল হৃদয়ের আকর্ষণে মানুষ তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হয়, ঝুকেঁ পড়ে। এ জন্যে অতি দ্রুত তিনি একটি শক্তিশালী উম্মাত গঠন করতে সক্ষম হন। অসম্ভব ভালোবাসা আর পারস্পরিক আন্তরিকতাপূর্ণ এই উম্মাত গঠনের পেছনে সহিংসতা কিংবা শক্তির বিন্দুমাত্র প্রয়োগ ছিল না। সেই ভালোবাসা আর আন্তরিক একতাপূর্ণ ধর্ম ইসলামকে কি সহিংসতার ধর্ম বলা যায়?

দ্বিতীয় পর্ব

কোরআনের শিক্ষাগুলোর দিকে একটু দৃষ্টি দিলে দেখা যাবে মানুষের মাঝে ভ্রাতৃত্ব এবং শান্তি প্রতিষ্ঠাই ইসলামের লক্ষ্য। পবিত্র কোরআনের সূরা বাকারার দুই শ’ আট নম্বর আয়াতে বলা হয়েছেঃ হে ঈমানদারগণ! তোমরা পরিপূর্ণভাবে শান্তি ও ভ্রাতৃত্বের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাও এবং শয়তানের পদাংক অনুসরণ করো না। নিশ্চিয়ই সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু। আল্লাহর আমাদের এই আয়াতের তাৎপর্য উপলব্ধি করার যোগ্যতা দিন।
যেই আয়াতটি আমরা উল্লেখ করেছি তাতে ‘ফিস সিল্‌মি’ শব্দটি এসেছে। সাল্ম্ এবং সালামের আভিধানিক অর্থ হলো শান্তি,সমঝোতা ও স্বস্তি। কোরআনের আয়াত থেকে আমরা জানতে পারছি মানব সমাজে দৃঢ় সমঝোতা এবং স্বস্তি নিশ্চিত হতে পারে বা বাস্তবায়িত হতে পারে কেবল আল্লাহর প্রতি ইমান আনার মধ্য দিয়ে। অন্যভাবে বলা যেতে পারে বিশ্বব্যাপী মানুষের মাঝে ভৌগোলিক, আঞ্চলিক, বর্ণ, গোত্র এবং ভাষাগত দিক থেকে হাজারো পার্থক্য বা ব্যবধান থাকা সত্ত্বেও তাদের মাঝে সামাজিক সংযোগের বৃত্তটি রচিত হতে পারে কেবল এই আল্লাহর প্রতি ইমানের ভিত্তিতে।
এই আয়াতটির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে কোরআনে মাজিদের বক্তব্য অনুযায়ী যারা এই শান্তি ও সমঝোতার পথ পরিহার করে যুদ্ধ ও সংঘাতের পথ বেছে নিয়ে আগুণের লেলিহান শিখা জ্বালিয়ে দেয়, তারা শয়তানের অনুসারী। তার মানে হলো সমঝোতা ও শান্তি হচ্ছে দয়াময় আল্লাহর কাজ আর সমাজে যুদ্ধ ও সংঘাতের আগুন জ্বালিয়ে দেওয়া বর্বর শয়তানের কাজ। সমঝোতা ও শান্তি সম্পর্কে কোরআনের আরেকটি আয়াতেও ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে। আল্লাহ বলেছেন যদি শত্রুরা ন্যায়সঙ্গত সমঝোতা বা সন্ধি করতে চায় তাহলে তা গ্রহণ করো। তবে অন্যায়, অসত্যের কাছে মাথানত করে কিংবা সত্যকে বিসর্জন দিয়ে সমঝোতা করা যাবে না। ঔদাসীন্য, ভয় ও আপোসের মানসিকতা নিয়ে সমঝোতা করা হলে ইসলাম তা সমর্থন করে না। পবিত্র কোরআনে এ ধরনের সমঝোতাকে তিরস্কার করা হয়েছে। সেইসাথে হুঁশিয়ার করে দেওয়া হয়েছে যে, শত্রুদের সাথে সমঝোতা হতে হবে মুমিনদের সম্মান ও মর্যাদা রক্ষার স্বার্থে।
ইমাম আলী (আ)মালেক আশতারকে মিশরের গভর্নর করে পাঠানোর পর এক চিঠিতে লিখেছেনঃ ‘শত্রুরা যদি তোমাকে সমঝোতা বা সন্ধির দিকে আহ্বান জানায় এবং তাতে যদি আল্লাহর সন্তুষ্টি থাকে তাহলে তা প্রত্যাখ্যান করো না। কেননা সন্ধি হচ্ছে,তোমার সেনাদের প্রশান্তির কারণ এবং তোমার নিজের জন্যেও ঝামেলামুক্তির কারণ, অপরদিকে তোমার শাসিত অঞ্চলের নিরাপত্তাও তার মধ্যে নিহিত। তবে সমঝোতার পর শত্রুদের ব্যাপারে খুব সতর্ক থাকবে। কারণ, হতে পারে শত্রুরা ঘনিষ্ট হয়ে বা তোমার কাছে ভিড়ে তোমাকে কিংকর্তব্যবিমূঢ় করে বা বোকা বানিয়ে হঠাৎ আক্রমণ করে বসতে পারে।’ ইমাম আলী (আ) এর দৃষ্টিতে ইসলাম হচ্ছে ঔদার্য ও মহানুভবতার সমষ্টি।আর আল্লাহ এই দ্বীনকে ইসলামে দীক্ষিতদের জন্যে সুস্থতা ও সংহতির আধার হিসেবে দিয়েছেন।

কোরআনে উল্লেখিত একটি বিষয় হলো ‘বন্ধুত্ব ও হৃদ্যতা’। আল্লাহর বৈশিষ্ট্য হিসেবে এগুলোর কথা উল্লেখ করা হয়েছে। আল্লাহর এই মহান মর্যাদা সম্পর্কে পবিত্র কোরআনের সূরা রোমের একুশ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছেঃ ‘আর এক নিদর্শন এই যে, তিনি তোমাদের জন্যে তোমাদের মধ্য থেকে তোমাদের সংগিনীদের সৃষ্টি করেছেন,যাতে তোমরা তাদের কাছে শান্তিতে থাক এবং তিনি তোমাদের মধ্যে পারস্পরিক সম্প্রীতি ও দয়া সৃষ্টি করেছেন। নিশ্চয় এতে চিন্তাশীল লোকদের জন্যে নিদর্শনাবলী রয়েছে।’এইসব বর্ণনা থেকে একটি প্রশ্ন নিশ্চয়ই চিন্তাশীলদের মাথায় আসবে তা হলোঃ যেই ধর্ম বা আদর্শ নিজেকে দয়া এবং প্রেমের ধর্ম বলে পরিচয় দেয় এবং তার অনুসারীদের মাঝে সেই প্রেম ও দয়ার বীজ রোপন করে, সেই ধর্ম বা সেই আদর্শ কি সহিংস হতে পারে?
বলছিলাম যে আল্লাহ হচ্ছেন রহমত ও দয়ার আধার। পবিত্র কোরআনে তাঁর গুণ ও মর্যাদার কথা খুবই সুন্দরভাবে বর্ণিত হয়েছে। এদিক থেকে ইসলামের ভিত্তিটাই হলো রহমত ও দয়ার মূলে। এই দয়া এতো বেশি এবং এতো বিস্তৃত যে যুদ্ধ কিংবা সংঘর্ষের সময়ও এই দয়াশীলতার বিষয়টি লক্ষ্য করা যায়। ইসলামের নবী (সা)মুশরিকদের সাথে মুখোমুখি হবার সময় তাদেরকে ইসলামের দাওয়াত দিতেন কিংবা তিনি চাইতেন তারা যেন মুসলমানদের ওপর আগ্রাসন বন্ধের ব্যাপারে চুক্তিবদ্ধ হয়। এ সম্পর্কে নবীজী বলেছেন,তাদেরকে প্রথমে ইমানের দাওয়াত না দিয়ে তাদের সাথে যুদ্ধে জড়াবে না। তারা যদি তা গ্রহণ না করে তবু তোমরা যুদ্ধ করো না যতোক্ষণ পর্যন্ত না তারা নিজেরাই যুদ্ধ শুরু না করে।

মুশরিকদের সাথে যুদ্ধ শুরু হয়ে যাবার পরও শত্রুদের সাথে,শত্রু পক্ষীয় বন্দীদের সাথে,আহতদের সাথে এবং বেসামরিক লোকজনের সাথে যেন মানবীয় নীতি নৈতিকতাগুলো মেনে চলা হয় সেজন্যে নবীজী তাঁর অনুসারীদের লক্ষ্য করে আদেশ দিতেন। ইসলামের বিভিন্ন বর্ণনায় যুদ্ধে কী ধরনের শিষ্টাচার এবং নীতি নৈতিকতা মেনে চলা উচিত সে সম্পর্কে চমৎকার কিছু দিক উল্লেখ করা হয়েছে। ইমাম সাদেক (আ) বলেনঃ ‘রাসূলে আকরাম (সা) যখন মুসলমান সেনাদেরকে যুদ্ধের ময়দানে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিতেন,তাদেরকে ডেকে পাঠাতেন এবং তাদেরকে স্পষ্টভাবে বলতেন,যুদ্ধের ময়দানের দিকে অগ্রসর হও তবে কামনা বাসনা চরিতার্থ করার লক্ষ্যে নয় বরং আল্লাহকে স্মরণ করতে করতে এবং তাঁরি সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে ইসলামের নীতিমালা অনুযায়ী আমল করতে করতে আল্লাহর রাস্তায় পা বাড়াও।’যুদ্ধের ময়দানের আদব বা শিষ্টাচার বলতে নবীজী যেটা বুঝিয়েছেন তাহলো:যুদ্ধের ময়দানে কখনোই শিষ্টাচার লঙ্ঘন করা যাবে না,প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করা যাবে না। খেয়ানতের পথে পা মাড়ানো যাবে না,বিশেষ করে গনিমতের মালামাল বণ্টনের ব্যাপারে কোনোরকম খেয়ানত করা যাবে না।

কোরআনে বলা হয়েছে,যখন গনিমতের মালামাল হাতে আসে তখন নেতৃত্ব আর হুকুমাতের ব্যাপারে দেওয়া প্রতিশ্রুতির কথা মনে থাকে না। তবে যা কিছু যোদ্ধাদের সাথে সম্পর্কিত সেগুলো তাদের মাঝে বণ্টন করে ফেলা ভালো যাতে নিজেদের প্রকৃত সত্যের কাছাকাছি পৌঁছা যায় এবং গনিমতে কোনোরকম খেয়ানত করা না হয়। না কেবল যুদ্ধের গনিমতের ব্যাপারেই নয় বরং যুদ্ধের সকল দিক নিয়েও যেন কোনোরকম খেয়ানত করা না হয়। নবীজী তাঁর বক্তব্যের ধারাবাহিকতায় আরো বলেনঃ অলা তুমাসসিলু। শত্রুদেরকে পরাস্ত করার পর তাদের নিষ্প্রাণ দেহগুলোর ওপর আক্রমণ করো না এবং লাশকে টুকরো টুকরো করো না।‘অলা তাগদিরু’ষড়যন্ত্রকারী,প্রতারক কিংবা চুক্তিভঙ্গকারী হয়ো না।’ আরো বলেছেন ‘অক্ষম, দুর্বল কিংবা যুদ্ধে যাদের কোনোরকম হাত নেই তাদের ওপর হামলা করো না। অক্ষম বৃদ্ধ, শিশু এবং নারীদের হত্যা করো না।’ এমনকি তিনি বলেছেন একান্ত নিরুপায় না হলে ‘বৃক্ষ পর্যন্ত কাটবে না।’শত্রু পক্ষের বন্দীরা মুসলমানদের হাতে নিরাপদ। সে যদি ইসলাম গ্রহণ করে তাহলে তো মুসলমানদের কাতারবন্দী হবে,আর যদি ইসলাম গ্রহণের ব্যাপারে অস্বীকৃতি জানায় কিংবা চিন্তা ভাবনা করার সুযোগ চায় তাহলে নিরাপত্তার সাথে তাকে তার স্বদেশে ফেরার ব্যবস্থা করতে হবে, তাকে কোনোরকম বিরক্ত করার অধিকার কারো নেই।’ এই ইসলাম কি কখনো সহিংস হতে পারে?

তৃতীয় পর্ব

ইসলামের অনুগ্রহ কেবল সকল মানবজাতির জন্যেই নয় বরং অন্যান্য সৃষ্টি এবং প্রাণীকূলের ক্ষেত্রেও সমানভাবে প্রযোজ্য। সেজন্যে প্রাণীকূলের অধিকার সম্পর্কেও বহু বর্ণনা রয়েছে। সে সম্পর্কে খানিকটা ইঙ্গিত দেওয়ার চেষ্টা করবো আজকের আসরে।
গত আসরে আমরা রণাঙ্গনে ইসলামী শিষ্টাচার সম্পর্কে বলেছিলাম যে প্রকৃতি জগতের ক্ষতি করা এমনকি গাছগাছালি তথা উদ্ভিদরাজিও ধ্বংস করা যাবে না। রাসূলে খোদা (দ.)পোষা প্রাণীর অধিকার সম্পর্কে বলেছেনঃ কোনো পোষা প্রাণীর মালিক যখন বাসায় ফেরে,তখন তার উচিত প্রথমেই প্রাণীটির পানাহারের ব্যবস্থা করে তার ক্ষুধা মেটানো, তারপর নিজের খাবারের চিন্তা করা। সফরকালে পথিমধ্যে পানির সন্ধান পাওয়া গেলে পোষা প্রাণীদেরকে পানি খাওয়াতে হবে,তারপর প্রয়োজন হলে নিজের তৃষ্ণা মেটাতে হবে। প্রাণীটিকে যদি আরো দ্রুততার সাথে চালাতে হয় তাহলে তার মাথায় কিংবা মুখে চাবুক মারা যাবে না কেননা পশুরাও আল্লাহর জিকির-তাসবিহতে মশগুল থাকে। পশুর পিঠে তার সাধ্যের চেয়ে বেশি বোঝা চাপানো যাবে না। আজকের পৃথিবীতে প্রাণীদের ব্যাপারে এইসব শিষ্টাচার খুব কমই মেনে চলা হয়। অথচ মানবতার ধর্ম ইসলাম তার অনুসারীদেরকে এইসব সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিষয়ও মেনে চলার আহ্বান জানায়।
আমরা নামায পড়ার সময় কিংবা রোযা পালনের সময় বিপদাপদ মুক্তির লক্ষ্যে আল্লাহর দরবারে দু’হাত তুলে মুনাজাত করি। মুনাজাতে আমরা যেসব দোয়া করি তার কিছু অংশ লক্ষ্যণীয়ঃ “হে খোদা! সকল কবরবাসীর ওপর আনন্দ ও খুশি নাযিল করো!অভাবগ্রস্তদের সকল অভাব অভিযোগ দূর করে দাও!বিশ্বের সকল ক্ষুধার্তের ক্ষুধা তৃষ্ণা তুমি মিটিয়ে দাও!হে খোদা!সকল ঋণগ্রস্তকে ঋণমুক্ত করে দাও!শোকার্ত,বেদনার্তদের সকল কাজের জটিল গ্রন্থি তুমি খুলে দাও! হে আল্লাহ!স্বদেশ থেকে যারা দূরে রয়েছে তাদেরকে তুমি সুস্থতার সাথে নিজের দেশে ফেরার ব্যবস্থা করে দাও!হে খোদা!বন্দীরা যেখানেই থাকুক না কেন তাদের মুক্তি পাবার ব্যবস্থা করে দাও!হে আল্লাহ!সকল রোগগ্রস্তকে তুমি আরোগ্য লাভের ব্যবস্থা করে দাও!”

আচ্ছা! এই দোয়াগুলো কি ইসলামের মানবতা ও দয়াশীলতার নমুনা নয়!এইসব দোয়ায় কেবল মুসলমানরাই নয় বরং পৃথিবীর সকল মানুষই অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। মানব প্রেমের এই অপূর্ব নিদর্শন দেখে কে মুগ্ধ না হয়ে পারে!
নবীজীর আহলে বাইতের ইমামগণের জীবনীর মধ্যেও এই দয়াশীলতার নিদর্শন পাওয়া যাবে। ইমাম আলী (আ)র মাথায় বিষাক্ত তরবারির আঘাত হেনে তাকেঁ শহিদ করেছিল ইবনে মুলজাম মুরাদি। সেই মুরাদির সাথে সদয় আচরণ করার নিদর্শন স্থাপন করে গেছেন ইমাম আলি। ইবনে মুলজামকে ধরার পর থেকে মৃত্যু পর্যন্ত তার প্রতি সদয় আচরণ করা হয়েছে। তিনি বলেছেনঃ “হে আমার সন্তানেরা!আমার হত্যাকারী শুধুমাত্র ইবনে মুলজাম। আমার পরে সুবিধাবাদী একটা দল তাদের তলোয়ার কোষমুক্ত করতে চাইবে,আমার হত্যাকারীর সাথে হাত থাকার অজুহাত দেখিয়ে কিংবা নিজেদের ব্যক্তিগত রেষারেষির ঝাল মেটাতে খুনাখুনি করতে পারে…এরকম যেন না হয়, সাবধান থেকো! আমার প্রিয় সন্তানেরা!আমার জন্যে যে খাবার তৈরি হবে,একই খাবার আমার হত্যাকারীকেও দেবে। আমি যদি বেঁচে থাকি,তাহলে কাতেলের সাথে যা করার আমিই করবো,আর যদি আল্লাহর সান্নিধ্যে চলে যাই তাহলে কেসাসের অধিকার তোমাদের রয়েছে। তবে যেভাবে সে আমার ওপর তরবারির একটিমাত্র আঘাত হেনেছে, তেমনি একটিমাত্র আঘাত হানবে তার ওপর, বেশি নয়।”

ইসলামের এরকম উদারতা আর দয়ার উদাহরণ সমগ্র পৃথিবীতে আর মিলবে!
অনেকে না জেনে ইসলামকে সহিংসতার ধর্ম বলে প্রমাণ করার জন্যে কেসাসের বিষয়টি উল্লেখ করে থাকে। পবিত্র কোরআনে কেসাস শব্দটি মাত্র চারবার এসেছে। কিন্তু রহমত শব্দটি এসেছে উনআশি বার,রাহমান শব্দটি এসেছে একশ’ ষাট বার,রাহিম শব্দটি এসেছে একশ’আটানব্বুই বার। এতেই প্রমাণিত হয় যে ইসলামে রহমত এবং দয়ার পাল্লা অন্য সবকিছুর চেয়ে ভারি। সূরা বাকারার একশ’আটাত্তর নম্বর আয়াতে কেসাসের বিধান দেওয়ার পরপরই বলা হয়েছেঃ “অতঃপর তার দ্বীনী ভাইয়ের পক্ষ থেকে যদি মাফ করে দেয়া হয় অর্থাৎ কেসাসকে যদি রক্তমূল্যে রূপান্তরিত করা হয়,তবে গ্রহণযোগ্য নিয়মের অনুসরণ করবে এবং হত্যাকারীও রক্তমূল্যের অনুগ্রহকে মৃত ব্যক্তির অভিভাবককে প্রদান করবে। এটা তোমাদের পালনকর্তার পক্ষ থেকে বিশেষ ছাড় এবং দয়া……।”

এই আয়াত অনুযায়ী কেসাস কিন্তু ফরজ নয় এমনকি মুস্তাহাবও নয়। তবে অপরাধ বিস্তার রোধকল্পে কিংবা একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঠেকাতে মৃত ব্যক্তির অভিভাবককে কেসাসের অধিকার যেমন দেওয়া হয়েছে তেমনি রক্তমূল্যের বিনিময়ে হত্যাকারীকে ক্ষমা করে দেওয়ারও অধিকার দেওয়া হয়েছে।
পৃথিবীর সকল দেশেই অপরাধের শাস্তির ব্যবস্থা রয়েছে। ইসলামেরও নীতি আদর্শের প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে অপরাধ দমনের কর্মসূচি গৃহীত হয়েছে। ইসলামসহ প্রত্যেক ধর্মই চায় মানুষ যাতে পাপের পথে পা না বাড়ায়। ইরানের বিশিষ্ট আলেম আয়াতুল্লাহিল উজমা মাকারেম শিরাযি কেসাসের বিধান সম্পর্কে বলেছেনঃ সমাজে ফেৎনা ফাসাদ বন্ধ করার জন্যে এবং অন্যদের নিরাপত্তা বিধানের জন্যে এটা এক ধরনের চিকিৎসা। সমাজের সামগ্রিক কল্যাণের স্বার্থে কেসাসের ব্যবস্থাটা আল্লাহর পক্ষ থেকে এক ধরনের রহমত। কেসাসের দর্শনকে কোরআনে জীবন বলে উল্লেখ করা হয়েছে। বলা হয়েছেঃ “হে বুদ্ধিমানগণ! কেসাসের মধ্যে তোমাদের জন্যে রয়েছে জীবন,যাতে তোমরা তাকওয়াবান হতে পার।”

এ আয়াত থেকে পরিস্কার বোঝা যাচ্ছে যে,কেসাসের বিধানের মধ্যে প্রতিহিংসার লেশমাত্র নেই বরং এতে রয়েছে আল্লাহর রহমত,যাতে অন্যরা প্রশান্তিতে নিজেদের জীবন অতিবাহিত করতে পারে। এদিক থেকে কেসাসের মধ্যে ঠিকই জীবন রয়েছে,একইভাবে মানুষ হত্যার মতো অপরাধ থেকে ফিরিয়ে রাখার উপাদানও রয়েছে।
কোনো রোগীর আঙুলে যদি এমন কোনো রোগ হয় যা ঔষধ দিয়ে কোনোভাবেই সারিয়ে তোলা যায় না,একজন চিকিৎসক যখন নিরুপায় হয়ে ঐ আঙুলটি কেটে ফেলেন,তাকে কি তখন সহিংসতা বলা যায়,কিংবা ডাক্তারকে কি সহিংসতাকামী বলা যায়?একটি আঙুল কেটে ফেলার ফলে পুরো শরীরটা মুক্তি পায় অর্থাৎ জীবন পায়। বৃক্ষের যে শাখাটি নষ্ট হয়ে যায় ঐ শাখাটিকে কেটে ফেলে দিলে বৃক্ষ জীবন ফিরে পায়। সমাজের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। কেননা সমাজটাও একটা দেহের মতো। সমাজদেহের কোনো অঙ্গে যদি প্রতিকার অযোগ্যরকমভাবে নষ্ট হয়ে যায় তাহলে সে অঙ্গ কেটে ফেলা হলে পুরো সমাজদেহ আক্রান্ত হওয়া থেকে বেঁচে যায়। সেজন্যেই আল্লাহ কেসাসের মধ্যে ‘জীবন’ রয়েছে বলে উল্লেখ করেছেন। মজার ব্যাপার হচ্ছে, মানবাধিকারের বুলি আওড়িয়ে যারা কেসাসের ব্যাপারে উদ্দেশ্যমূলকভাবে নেতিবাচক কথা বলে, তারাই ফিলিস্তিন, আফগানিস্তান, লেবানন, ইরাকসহ পৃথিবীর আরো বহু দেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ব্যাপারে টু-শব্দটিও করছে না। আল্লাহ কেসাসের বিধানটি দিয়েছেন বুদ্ধিমানদের সম্বোধন করে। তার মানে এর মধ্যে যে সামাজিক প্রাণ নিহিত রয়েছে তা বুদ্ধিমানরাই উপলব্ধি করতে পারে। আল্লাহ সবাইকে বুদ্ধি ও বিচক্ষণতা দান করুন, তাকওয়াবান হবার সুযোগ দিন। #

সংগৃহিত।

কুরআনের ছোঁয়ায় বদলে যাক এ জীবন।

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম

ভূমিকা: আল কুরআন মহান আল্লাহর বাণীর অপূর্ব সমাহার বিস্ময়কর এক গ্রন্থের নাম। আল কুরআন আল্লাহর পক্ষ থেকে অবতীর্ণ সংরক্ষিত এক সংবিধান। এই কুরআন যেমন সমগ্র মানবজাতির মানসিক সংশয়, সন্দেহ, অস্পষ্টতা, কুপ্রবৃত্তি, লোভ-লালসা নামক নানারকম রোগ-ব্যাধি নিরাময়ের অব্যর্থ মহৌষধ ঠিক তেমনি দৈহিক রোগ-ব্যাধি, বেদনা, কষ্ট-ক্লেশ এবং জীবন চলার পথের সকল অন্ধকার বিদূরিত করার এক অনবদ্য নির্দেশিকা। এই কুরআন হল, সত্য-মিথ্যা এবং বৈধ-অবৈধের সীমা-রেখা নির্ধারণের এক সুউচ্চ মাইল ফলক, সুখ সমৃদ্ধ জীবনের বিশ্বস্ত ঠিকানা এবং পশ্চাদপদতা, দুর্ভাগ্য ও হতাশার গ্লানি থেকে মুক্তির অনুপম গাইড লাইন।

বিশ্ববাসীর প্রতি আল কুরআনের চ্যালেঞ্জ:

আল কুরআন কিয়ামত পর্যন্ত অনাগত বিশ্বের এক চিরন্তন বিস্ময়। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন সমগ্র মানব ও দানব জাতির প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছেন-কুরআনের মত আরেকটি গ্রন্থ তারা সবাই মিলে রচনা করুক তো। কিন্তু কাল প্রবাহে সবাই ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। ইরশাদ হচ্ছে:
قُلْ لَئِنِ اجْتَمَعَت الْأِنْسُ وَالْجِنُّ عَلَى أَنْ يَأْتُوا بِمِثْلِ هَذَا الْقُرْآنِ لا يَأْتُونَ بِمِثْلِهِ وَلَوْ كَانَ بَعْضُهُمْ لِبَعْضٍ ظَهِيراً
“বলুন, যদি মানব ও জিন সকলে কুরআনের অনুরূপ রচনা করার জন্য একত্রিত হয়, এবং তারা পরস্পরে সাহায্যকারী হয়; তবুও তারা এর অনুরূপ রচনা করতে পারবে না।” (সূরা বানী ইসরাঈলঃ ৮৮)
আবার চ্যালেঞ্জ দেয়া হয়েছে, পুরো গ্রন্থ নয়; কুরআনের মত দশটি সূরা তারা রচনা করুক তো। কিন্তু তাতেও সবাই ব্যর্থ হয়েছে। ইরশাদ হচ্ছে:
أَمْ يَقُولُونَ افْتَرَاهُ قُلْ فَأْتُوا بِعَشْرِ سُوَرٍ مِثْلِهِ مُفْتَرَيَاتٍ وَادْعُوا مَنِ اسْتَطَعْتُمْ مِنْ دُونِ اللَّهِ إِنْ كُنْتُمْ صَادِقِينَ
“তারা কি বলে কুরআন সে (অর্থাৎ নবী মোহাম্মাদ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিজে তৈরি করেছে? আপনি বলে দিন, তবে তোমরাও অনুরূপ দশটি সূরা তৈরি করে নিয়ে আস। আর আল্লাহ ছাড়া যাকে পারো ডেকে নাও। যদি তোমাদের কথা সত্য হয়ে থাকে।” (সূরা হুদ: ১৩)
আবারো চ্যালেঞ্জ ঘোষণা করা হয়েছে, মাত্র একটি সূরা তারা রচনা করুক। কিন্তু এতেও তারা ব্যার্থতার পরিচয় দিয়েছে । আল্লাহ তায়ালা বলেন:
وَإِنْ كُنْتُمْ فِي رَيْبٍ مِمَّا نَزَّلْنَا عَلَى عَبْدِنَا فَأْتُوا بِسُورَةٍ مِّنْ مِثْلِهِ وَادْعُوا شُهَدَاءَكُمْ مِنْ دُونِ اللَّهِ إِنْ كُنْتُمْ صَادِقِين
“আমি আমার বান্দার নিকট যা অবতীর্ণ করেছি সে ব্যাপারে যদি তোমাদের কোন সন্দেহ থাকে তবে এর মত একটিমাত্র সূরা রচনা করে নিয়ে আস তো। এবং আল্লাহ ছাড়া তোমাদের অন্যান্য সাহায্যকারীদেরকেও ডেকে নাও, যদি তোমরা সত্যবাদী হয়ে থাক।” (সূরা বাকারাঃ ২৩)

আল কুরআন বরকতময় এক গ্রন্থের নাম:

যাবতীয় কল্যাণ, সর্বপ্রকার জ্ঞান-গরিমা, প্রজ্ঞা ও রহস্যের আধার হল আল কুরআন। একে অনুসরণ করেই দুনিয়া ও আখেরাতে পাওয়া যায় সুখের সন্ধান, মেলে সঠিক পথের দিশা। পক্ষান্তরে কুরআন থেকে দূরে থাকলে, কুরআনকে একমাত্র সংবিধান হিসেবে গ্রহণ না করলে নানারকম দুর্ভাগ্য, দুশ্চিন্তা, হতাশা, ব্যঞ্জনা ইত্যাদি মানব জীবনকে ঘিরে ফেলে, প্রতি পদে নেমে আসে গহীন অন্ধকার।
কুরআন দেয় নিজের পরিচয়:

কুরআন সকল রোগের প্রতিষেধক এবং বিশ্ববাসীর জন্য রহমত স্বরূপঃ আল্লাহ তা’য়ালা ইরশাদ করেনঃ وَنُنَزِّلُ مِنَ الْقُرْآنِ مَا هُوَ شِفَاءٌ وَرَحْمَةٌ لِلْمُؤْمِنِين “আমি কুরআনে এমন বিষয় নাযিল করি যা রোগের প্রতিষেধক এবং মুমিনদের জন্য রহমত।” (সূরা বানী ইসরাঈলঃ ৮২)
সত্যের দিশারী এবং আলোকবর্তীকাঃ আল্লাহ তা’য়ালা বলেনঃ “এই কুরআন দ্বারা আল্লাহ তা’য়ালা যারা তাঁর সন্তষ্টি কামনা করে তাদেরকে শান্তির পথ দেখান, স্বীয় নির্দেশ দ্বারা অন্ধকার থেকে আলোর পথে নিয়ে আসেন এবং তাদেরকে প্রদান করেন সরল-সোজা পথের দিশা।” (সূরা মায়িদাহঃ ১৬)
সত্য পথের পথিকদের মহাপুরস্কারের শুভ সংবাদ দেয় কুরআনঃ ইরশাদ হচ্ছেঃ “আল্লাহ এ(জান্নাতেরই) শুভ সংবাদ প্রদান করে সে সব বান্দাকে যারা বিশ্বাস স্থাপন করে এবং সৎকর্ম করে। বলুন, আমি তোমাদের নিকট কোন প্রতিদান চাই না। শুধু চাই আত্মীয়তাজনিত সৌহার্দ্য। কেউ উত্তম কাজ করলে আমি তার সোয়াব বৃদ্ধি করে দেই। আল্লাহ তো ক্ষমাকারী এবং গুণগ্রাহী।” (সূরা শূরাঃ ২৩)
জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রজ্ঞার আধার: আল্লাহ তা’য়ালা ইরশাদ করেন:
ذَلِكَ نَتْلُوهُ عَلَيْكَ مِنَ الْآياتِ وَالذِّكْرِ الْحَكِيم

“আমি তোমাদেরকে এসমস্ত আয়াত এবং বিজ্ঞানময় উপদেশ বানী পড়ে শুনাই। (সূরা আলে ইমরান: ৫৮)

আত্বা ও জীবনের স্পন্দনঃ আল্লাহ বলেনঃ وَكَذَلِكَ أَوْحَيْنَا إِلَيْكَ رُوحاً مِنْ أَمْرِنَا “এমনিভাবে আমি আমার নির্দেশক্রমে তোমার নিকট আত্মা সঞ্চারকারী বিষয় প্রেরণ করেছি। (সূরা শুরাঃ ৫২)
সব কিছুর নির্ভুল তথ্য ও জ্ঞান দান করে আল কুরআন: আল্লাহ তা’য়ালা ইরশাদ করেন, “আর যত প্রকার প্রাণী পৃথিবীতে বিচরণশীল রয়েছে এবং যত প্রকার পাখি দু ডানা যোগে উড়ে বেড়ায় তারা তোমাদের মতই একেকটা জাতি। এই গ্রন্থে আমি কোন কিছুই লিখতে বাদ দেই নি। পরিশেষে সবাই তাদের প্রতিপালকের নিকট ফিরে আসবে।” (সূরা আনআমঃ ৩৮)
আল্লাহ নিজেই কুরআনের শপথ করে বলেছেন, তা অতি মর্যাদাবানঃ তিনি বলেনঃق وَالْقُرْآنِ الْمَجِيد “ক্বাফ। শপথ এই মর্যাদাবান কুরআনের। (সূরা ক্বাফঃ ১)
আল্লাহ তা’য়ালা বান্দাদেরকে কুরআন নিয়ে গবেষণা করার নির্দেশ প্রদান করে বলেছেন, যারা তা করে না তারা অন্ধ এবং বদ্ধ হৃদয়ের অধিকারী। তিনি বলেন:

أَفَلا يَتَدَبَّرُونَ الْقُرْآنَ أَمْ عَلَى قُلُوبٍ أَقْفَالُهَا
“তারা কি কুরআন নিয়ে গভীরভাবে গবেষণা করে না? না তাদের অন্তর তালাবন্ধ?” (সূরা মুহাম্মাদঃ ২৪)
এখান থেকে বোঝা যাচ্ছে, কুরআনের সম্মান কত বেশি! কুরআন পাঠ করা, মুখস্থ করা, কুরআন নিয়ে গবেষণা করা, কুরআনের অর্থও মর্মবাণী উপলব্ধি করার চেষ্টা করা, একে নিয়ে আলোচনা-পর্যালোচনা করার মর্যাদা কত উন্নত!
সুতরাং এমন কে আছে যে এ মর্যাদা লুফে নিতে চায়? কোথায় কুরআনের হাফেযগণ? কোথায় কুরআন প্রেমিক তরুণেরা? কোথায় কুরআন পাগল ঈমানদার বন্ধুগণ? আসুন, এই কুরআনের আহবানে সাড়া দেই। কুরআনের রঙ্গে রাঙ্গিয়ে দেই আমাদের দেহ, মন সমাজ ও পরিবেশ। গড়ে তুলি ঐশী আলোয় আলোকিত এক সুন্দর পৃথিবী।
কুরআনরে মর্যাদাঃ

কুরআন শিক্ষা করা এবং অন্যকে শিক্ষা দেয়াঃ

মহান আল্লাহ ইরশাদ করেনঃ قُلْ كَفَى بِاللَّهِ شَهِيداً بَيْنِي وَبَيْنَكُمْ وَمَنْ عِنْدَهُ عِلْمُ الْكِتَابِ “বলুন, আমার ও তোমাদের মধ্যে সাক্ষী হিসেবে আল্লাহই যথেষ্ট এবং ঐ ব্যক্তি যার কাছে কিতাব (কুরআন)এর জ্ঞান আছ। (সূরা রা’দঃ ৪৩)
রাসূলুল্লাহ (সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলছেনেঃ ((خَيْرُكُمْ مَنْ تَعَلَّمَ الْقُرْآنَ وَعَلَّمَه)) “তোমদের মধ্যে সেই উত্তম যে নিজে কুরআন শিক্ষা করে এবং অন্যকে শিক্ষা দেয়। (সহীহ বুখারী)। (সহীহ বুখারী)
কুরআন পাঠ করাঃ রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলনেঃ

اقْرَءُوا الْقُرْآنَ فَإِنَّهُ يَأْتِي يَوْمَ الْقِيَامَةِ شَفِيعًا لِأَصْحَابِهِ
“তোমরা কুরআন পাঠ কর। কনেনা, কুরআন কয়িামতরে দনি তার পাঠকদরে জন্য শুপারশি করব।” (সহীহ মুসলমি)।
– তিনি আরও বলেন: “কুরআনের অভিজ্ঞ ব্যক্তি পূত পবিত্র সম্মানিত ফেরেশতাদের সাথে অবস্থান করবে। আর যে তোতলায় অথচ তার পরও কষ্টকরে কুরআন পাঠ করে সে দ্বিগুণ সোয়াবের অধিকারী হবে। (বুখারী ও মুসলিম)।
-তিনি আরও বলেন: “আল্লাহর কিতাব থেকে যে একটি হরফ পড়বে সে তার বিনিময়ে একটি সোয়াব পাবে। আর একটি সোয়াব দশটি সোয়াবের সমান। আমি তোমাদেরকে বলি না যে “আলিফ-লাম-মীম একটি হরফ, বরং আলিফ একটি হরফ, লাম একটি হরফ, মীম একটি হরফ। (তিরমিযী, হাসান-সহীহ্‌)।
– তিনি আরও বলেন:
إِنَّ الَّذِي لَيْسَ فِي جَوْفِهِ شَيْءٌ مِنْ الْقُرْآنِ كَالْبَيْتِ الْخَرِبِ
“যার পেটে মোটেও কুরআন নেই সে তো একটা বিরান ঘরের মত। (তিরমিযী, হাসান-সহীহ)

কুরআন পাঠের আদব:

১) সকল কাজে ইখলাস থাকা অপরিহার্য। সুতরাং পবিত্র কুরআনও আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আশায় একান্ত খালেস অন্তরে পাঠ করা আবশ্যক।
২)কুরআনের অর্থ বুঝে, সচেতনভাবে, গবেষণার দৃষ্টি নিয়ে পাঠ করা। উদাসীন মনে কুরআন পাঠ করা উচিৎ নয়।
৩) পাক-পবিত্র হয়ে মিসওয়াক করে পড়তে বসা।
৪) কুরআন পড়া শুরু করার আগে ‘আঊযুবিল্লাহি মিনাশ্‌ শায়তানির রাজীম’ পড়া।
৫) ‘সূরা তাওবা’ ছাড়া প্রত্যেক সূরার প্রথমে ‘বিস্‌মিল্লাহির রাহমানির রাহীম পাঠ করা।
৬) যথাসম্ভব সুললিত কণ্ঠে পাঠ করা। এবং ভয়-ভীতি সহকারে কান্না বিজড়িত অবস্থায় পাঠ করা।
৭) সিজদার আয়াত আসলে সিজদাহ্‌ করা।
৮) বায়ু নির্গত হলে, হাই উঠলে বা মনোযোগ না থাকলে কুরআন বন্ধ করা উচিৎ।
৯) পরিষ্কার ও বিশুদ্ধ উচ্চারণে পাঠ করা।
১০) আমল করার উদ্দেশ্যে পড়া।
১১) পড়ার সময় এ কল্পনা করা যে, আল্লাহ তা’য়ালা এ আয়াত দ্বারা আমাকেই সম্বোধন করছেন।
১২) আল্লাহর দয়া-অনুকম্পা এবং নেয়ামতরাজি সংক্রান্ত আয়াত আসলে তাঁর কাছে দয়া-অনুগ্রহ কামনা করা এবং জাহান্নামের শাস্তির আলোচনা আসলে আল্লাহর নিকট পরিত্রাণ কামনা করা।

আমাদের অবস্থা:

আমাদের অবস্থা পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, আমরা কুরআনের শিক্ষা ও আদর্শ থেকে অনেক অনেক দূরে অবস্থান করছি। অনেক মানুষ আদৌ কুরআন পড়তে জানে না। অনেকে পড়তে জেনেও একটি বারের জন্য কুরআন খুলে পড়তে বসার তাদের সুযোগ হয় না। অনেকে নামাযে যতটুকু পড়ে ততটুকুই। নামাযের বাইরে মোটেও পড়ে না। কেউ আবার বিপদে না পড়লে কুরআনের ধারে কাছেও যায় না। অনেকে কুরআন পড়ে কিন্তু তার অর্থ বোঝার চেষ্টা করে না, কুরআন নিয়ে গবেষণা করে না। অনেকে কুরআন পড়ে কিন্তু আমল নেই। আরও ভয়ানক কথা হচ্ছে, আমাদের সমাজে এমন কতিপয় শিক্ষিত-মূর্খ লোকের অস্তিত্ব পাওয়া যায়, যারা কুরআনের অনেক আয়াতকে অস্বীকার করতেও কুণ্ঠিত হয় না। এরা বলে, কুরআনের আইন বর্তমান যুগের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এটাই হল, সুস্পষ্ট কুফুরী এবং ইসলাম বিদ্বেষীদের পথ।

কুরআনকে কিভাবে পরিত্যাগ করা হয়?

আল্লামা ইব্‌ন কায়্যেম (রহঃ) বলেন, কুরআনকে কয়েক ভাবে পরিত্যাগ করা হয়:
এক: কুরআন শ্রবণ না করা, কুরআনের প্রতি বিশ্বাস পোষণ না করা এবং কুরআনের প্রতি মনোযোগ না দেয়া।
দুই: আমল না করা, বৈধ-অবৈধের প্রতি তোয়াক্কা না করা। যদিও পড়ে এবং বিশ্বাস করে।
তিন: দ্বীনের মৌলিক এবং শাখা সর্বক্ষেত্রে কুরআনকে সংবিধান হিসেবে গ্রহণ না করা।
চার: কুরআনের অর্থ এবং ব্যাখ্যা না জানা এবং কুরআনের মধ্যে আল্লাহ তায়ালা কি বলতে চেয়েছেন তা অনুধাবন করার চেষ্টা না করা।
কু প্রবৃত্তি মনের যাবতীয় রোগ-ব্যাধির চিকিৎসা করতে কুরআন থেকে সাহায্য না নেয়া।
উল্লেখিত বিষয়গুলো সবই এ আয়াতের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায় যেখানে আল্লাহ তা’য়াল বলেন:

وَقَالَ الرَّسُولُ يَا رَبِّ إِنَّ قَوْمِي اتَّخَذُوا هَذَا الْقُرْآَنَ مَهْجُورًا
“রাসূল (সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, হে আমার পরওয়ারদেগার, আমার সম্প্রদায় এ কুরআনকে পরিত্যাগ করেছে। (সূরা ফুরকান: ৩০) যদিও উল্লেখিত দিকগুলো কোনটা বেশী কঠিন, কোনটা তুলনা মূলক হালকা।

কুরআন থেকে দূরে থাকার কারণ:

যেসব কারণে মানুষ কুরআন থাকে দূরে থাকে বা কুরআন পরিত্যাগ করে সেগুলো নিন্ম রূপ:
১) কুরআনকে সে অবিশ্বাস করে বা মিথ্যা মনে করে যদিও সে তা প্রকাশ করে না।
২) কুরআনের মর্মবাণী এবং বিস্ময়কর দিকগুলোর ব্যাপারে সে অজ্ঞ।
৩) দুনিয়া নিয়ে সে এতটাই মগ্ন যে পরকালকে ভুলে গেছে।
৪) গান-বাজনা শোনায় অভ্যস্ত বা গান-বাজনা চর্চা করে।
৫) আজ নয়, কাল থেকে শুরু করব এভাবে সময় ক্ষেপণ করতে থাকা।
৬) কুরআন বাদ দিয়ে অন্য জ্ঞান চর্চায় সময় ব্যয় করা। যেমন, কতিপয় মানুষ ইসলামী জ্ঞান চর্চার নামে হাদীস, ফিক্‌হ, ইসলামী সাহিত্য ইত্যাদি নিয়ে সার্বক্ষণিক সময় ব্যয় করে কিন্তু একবারও কুরআন পড়তে বসে না। এটা খুবই দূষণীয়। বরং উচিৎ হল, এসবের মাঝে ভারসাম্য রক্ষা করা। কারণ, কুরআন বাদ দিয়ে কোন জ্ঞানই অর্জন করা সম্ভব নয়।

কুরআনের ছোঁয়ায় বদলে যাক জীবন:

আবদুল্লাহ ইব্‌ন মাসউদ (রা:) বলেন, “ক্বারী তথা কুরআন প্রেমিক মানুষের তো এমন হওয়া উচিৎ, গভীর রাতে মানুষ যখন ঘুমের ঘোরে ডুবে থাকে তখন সে কুরআন তেলাওয়াত করে। দিনের বেলায় সবাই যখন খাবার-দাবারে লিপ্ত থাকে তখন সে কুরআন নিয়ে ব্যস্ত থাকে। সবাই যখন হাঁসি-তামাশায় মত্ত থাকে তখন সে আল্লাহর দরবারে চোখের পানিতে বুক ভাষায়। মানুষ যখন নির্বিঘ্নে সবার সাথে মিশে তখন সে পরহেযগারীতা অবলম্বন করে এবং ভালো মানুষ ছাড়া খারাপ মানুষের সংস্পর্শ থেকে দূরে থাকে। মানুষ যখন অন্যের দোষ চর্চা এবং অনর্থক আলাপচারীটায় সময় কাটায় তখন সে নীরবতার ভূমিকা পালন করে। মানুষ যখন দাম্ভিক এবং অহংকারপূর্ণ আচরণ করে তখন সে অতি নম্র ও ভদ্র স্বভাবের পরিচয় দেয়। অন্যেরা যখন আনন্দ-উল্লাসে মেতে থাকে তখন সে বিভোর থাকে পরকালের চিন্তায়।
হে আল্লাহ! হে পরম দয়ালু!! তুমি আমাদেরকে কুরআনের আলোয় আলোকিত মানুষ বানাও। কুরআনের ছায়া তলে গড়ার তাওফিক দাও আমাদের ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্র, শিক্ষা, সংস্কৃতি অর্থনীতি সহ জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্র। আল্লাহ আমাদের সহায় হোন। আমীন॥
অনুবাদক: আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল
লিসান্স: মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, সৌদী আরব
জুবাইল দা’ওয়া এন্ড গাইডেন্স সেন্টার, সৌদী আরব